বাংলার ভোর প্রতিবেদক

বাংলা সাহিত্যের মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের স্মৃতিবিজড়িত কপোতাক্ষ নদ খননে বারবার প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে, টাকা খরচ হচ্ছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না। সুফলও প্রত্যাশা অনুযায়ী পাওয়া যাচ্ছে না। উল্টো নদ খনন নিয়ে নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক প্রতিবেদনে অনিয়মের নানা তথ্য উঠে এসেছে। নদের ২০ কিলোমিটার এলাকা ঘুরে প্রায় একই রকম চিত্র দেখেছেন। নদ যতটুকু খননের কথা, তা করা হচ্ছে না। খনন করে মাটি রাখা হচ্ছে নদের দুই পাশে। এতে এক দিকে বৃষ্টিতে মাটি আবার নদে এসে পড়ছে। অন্যদিকে ফেলে রাখা মাটি কৃষকের জমি নষ্ট করছে। অপরিকল্পিত সেতুর কারণে অনেক স্থানে খনন করা যাচ্ছে না। কচুরিপানা পরিষ্কারের কথা থাকলেও তা সরানো হচ্ছে না। নদের তীরে বৃক্ষরোপণের কথা; সেটিও ঠিকমতো হচ্ছে না।

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, কপোতাক্ষে প্রাণ ফেরাতে ২০১১ সালে নদ খননের প্রকল্প হাতে নেয় পাউবো। ২৮৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘কপোতাক্ষ নদের জলাবদ্ধতা দূরীকরণ প্রকল্প (প্রথম পর্যায়)’ শেষ হয় ২০১৭ সালে। যদিও খুব একটা সুফল পাওয়া যায়নি তখন। নদ খননে তখনো অনিয়মের অভিযোগ ওঠে, স্থানীয় লোকজন মানববন্ধন করেন। ২০২০ সালে দ্বিতীয় পর্যায়ে খননকাজ শুরু করে পাউবো। এতে ব্যয় হচ্ছে ৫৩১ কোটি টাকা। দুই প্রকল্পে ব্যয় দাঁড়াচ্ছে ৮১৭ কোটি টাকা। নতুন প্রকল্পের কাজ ৩০ জুন কাজ শেষ হওয়ার কথা। এখন পর্যন্ত ৬৫ শতাংশ শেষ হয়েছে। প্রকল্পের মেয়াদ আরও এক বছর বাড়ানো হচ্ছে। নতুন প্রকল্পের উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপি) বলা হয়েছে, খননের উদ্দেশ্যে নদী ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন, পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন, শুষ্ক ও খরা মৌসুমের ক্ষতি কমানো। নদ পাড়ের বাসিন্দারা বলছেন, সেচ মৌসুমে নদটিতে পানি থাকে না। বেশি ব্যয়ে পানির ব্যবস্থা করে তাদের কৃষিকাজ করতে হয়। এ কারণেই মূলত নদটি খনন করা দরকার ছিল। কিন্তু টাকা খরচ হলেও কাজ ভালোভাবে হচ্ছে না।

২০২০ সালে দ্বিতীয় পর্যায়ে খননকাজ শুরু করে পাউবো। এতে ব্যয় হচ্ছে ৫৩১ কোটি টাকা। দুই প্রকল্পে ব্যয় দাঁড়াচ্ছে ৮১৭ কোটি টাকা। নতুন প্রকল্পের কাজ ৩০ জুন কাজ শেষ হওয়ার কথা। এখন পর্যন্ত ৬৫ শতাংশ শেষ হয়েছে। প্রকল্পের মেয়াদ আরও এক বছর বাড়ানো হচ্ছে। কপোতাক্ষ খননের পর পাড়ে মাটি স্তূপ করে রাখা হয়েছে। আর নদের ওপর আড়াআড়িভাবে দেওয়া হয়েছে মাটির বাঁধ। সম্প্রতি চৌগাছা উপজেলায় মাশিলা সেতুর দক্ষিণ পাশে কপোতাক্ষ খননের পর পাড়ে মাটি স্তূপ করে রাখা হয়েছে। আর নদের ওপর আড়াআড়িভাবে দেওয়া হয়েছে মাটির বাঁধ।

সরেজমিনে নদপাড়ে উপজেলার নারায়ণপুর সেতু এলাকা থেকে কাবিলপুর এলাকা পর্যন্ত ঘুরে নদের ১৫ কিলোমিটারে অন্তত ৯টি জায়গায় আড়াআড়ি মাটির বাঁধ পাওয়া যায়। নারায়ণপুর সেতু থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে ডাক বাংলাপাড়া এলাকায় আড়াআড়িভাবে একটি মাটির বাঁধ দেওয়া হয়েছে। নদের এই অংশে দুটি খননযন্ত্র (এক্সকাভেটর) দিয়ে নদের বাঁ পাশ খনন করা হচ্ছে। খননের পর মাটি ফেলা হচ্ছে নদের পাড়ে। আরও দুটি খননযন্ত্র দিয়ে সেই মাটি একটু দূরে ফেলা হচ্ছে। ডাক বাংলাপাড়া এলাকা থেকে কপোতাক্ষ সেতু (চৌগাছা সেতু) পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার অংশে নদটি ভরে আছে কচুরিপানায়।

পাঁচনামনা গ্রামের বাসিন্দা আবুল কাসেম বলেন, মাটি কেটে নদের পাশেই ফেলা হচ্ছে। বর্ষাকালে মাটি ধুয়ে নদের মধ্যে পড়বে।
চৌগাছা বাজারে কপোতাক্ষ সেতু থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দক্ষিণে হুদা চৌগাছা এলাকায় নদের মধ্যে আড়াআড়িভাবে আরেকটি মাটির বাঁধ দেওয়া হয়েছে। নদের এই অংশে কিছুটা জায়গাজুড়ে স্বচ্ছ পানি আবার কিছু জায়গাজুড়ে কচুরিপানায় ভরে আছে। নদের ডান তীরে কোথাও কোথাও ছোট ছোট ভাঙন দেখা দিয়েছে। সেখান থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দক্ষিণে মাশিলা সেতু। সেতুর দুই পাশে দুটি খননযন্ত্র দিয়ে নদ খনন করা হচ্ছে। দীঘলসিংহা গ্রামের কৃষক আজিজুর রহমান বলেন, ‘নদের পাড়ে মাঠ। মাঠে আমার জমি আছে। নদ কাটার মাটি পাশের মাঠে ফেলা হচ্ছে। এতে আমাদের ক্ষতি হচ্ছে। একটু বৃষ্টি হলে স্রোতে পাড় ভেঙে নদের মধ্যে পড়বে। এ ছাড়া ঝিকরগাছা উপজেলায় নদের আরও ৫ কিলোমিটার অংশ ঘুরে দেখে বৃক্ষরোপণের কথা থাকলেও সেসব স্থানে নদের তীরে কোথাও গাছ লাগাতে দেখা যায়নি।

এসব বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) যশোর কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী পলাশ কুমার ব্যানার্জি বলেন, কপোতাক্ষ নদের প্রায় ৬৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। নদ খননের মাটি পাশে রাখা হচ্ছে। জেলা পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা কমিটির বৈঠকে ওই মাটি নিলামে বিক্রি করে টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। চৌগাছা ও ঝিকরগাছা অংশের খনন শেষ হলে নিলাম করে ওই মাটি বিক্রি করা হবে। মাটি বিক্রির পর বন বিভাগ নদের পাড়ে গাছ লাগাবে। সরকারি হিসাবে কপোতাক্ষ নদের দৈর্ঘ্য ১৮০ কিলোমিটার। এ প্রকল্পের আওতায় ছয়টি এলাকায় নদ খনন করা হচ্ছে।

কপোতাক্ষ নদের জলাবদ্ধতা দূরীকরণ প্রকল্পটি যশোর, ঝিনাইদহ, সাতক্ষীরা ও খুলনা জেলার মোট ১১টি উপজেলায় বাস্তবায়িত হচ্ছে। আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়, যশোরের মনিরামপুর উপজেলায় নদের ৫০ থেকে ৬০ কিলোমিটার, এই ১০কিলোমিটার এলাকা একটি প্যাকেজে খনন করা হয়েছে। আইএমইডির প্রতিনিধিদল সরেজমিনে দেখতে পায়, খনন করা মাটি রাখা হয়েছে নদের পাড়ে। সেখানে নদের দুই পাড়ে ভাঙন দেখা দিয়েছে। ওই ১০ কিলোমিটার এলাকায় চার হাজার গাছ লাগানো হয়। তার মধ্যে ৩৫ শতাংশ গাছ মরে গেছে। একই উপজেলায় ৬০ থেকে ৬৯ কিলোমিটার পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৩ লাখ কিউবিক মিটার মাটি খননের কথা থাকলেও করা হয়েছে ২ লাখ ৭০ হাজার কিউবিক মিটার। এ অংশে ১ হাজার ৬৮০টি গাছের চারা লাগানো হয়। বেঁচে আছে ৬০ শতাংশ গাছ। সেখানেও খননের পর নদের দুই পাশ ভাঙছে। ৬৯ থেকে ৭৫ কিলোমিটার এই ৬ কিলোমিটার একটি প্যাকেজের আওতায় খনন করা হয়। খনন করা মাটি রাখা হয়েছে নদের পাড়ে।

সেখানে নদের দুই পাড় দেবে গেছে। নদের দুই পাড়ে ভাঙন দেখা দিয়েছে। যশোরের সাগরদাঁড়িতে দেখা যায়, ব্লক নির্মাণের প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি। কপোতাক্ষ নদের ডান তীরে বালিয়া নামক স্থানে দেখা যায়, সর্বনিম্ন পানির স্তরে নিচে জিও ব্যাগ ডাম্পিং করার কথা থাকলেও তা করা হয়নি। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, কপোতাক্ষ নদ খননের আওতায় এ পর্যন্ত ৩ হাজার ৬০০টি গাছের চারা রোপণ করা হয়েছে। এর মধ্যে অর্ধেক চারা বেঁচে আছে। ডুমুরখালী গ্রামের বাসিন্দা জাবেদ আলী জানান, চারা পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়নি।

কপোতাক্ষ বাঁচাও আন্দোলনের প্রধান উপদেষ্টা ইকবাল কবির জাহিদ বলেন, কপোতাক্ষ নদ খনন প্রকল্পে নদীতট আইন মানা হচ্ছে না। তা ছাড়া নদের দুই পাশে গভীর করে কাটা হলেও মাঝখানে ঠিকমতো কাটা হচ্ছে না। মাঝখানে উঁচু থাকছে। নদ খননের মাটি নদের গর্ভে ফেলা হচ্ছে। এভাবে মাটি ফেললে বর্ষা মৌসুমে পাড় ভেঙে মাটি নদের মধ্যে পড়বে। যেভাবে নদ খনন করা হচ্ছে, তাতে প্রকল্পের সুফল পাওয়া যাবে না।

Share.
Leave A Reply Cancel Reply
Exit mobile version