শরিফুল ইসলাম
বেগম খালেদা জিয়ার জীবনবৃত্তান্ত শুধু একজন ব্যক্তির উত্থানের গল্প নয়; এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক দীর্ঘ, জটিল ও সংগ্রামমুখর অধ্যায়। সামরিক শাসন, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, ক্ষমতার পালাবদল, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও ব্যক্তিগত দুর্ভোগ—সবকিছুর ভেতর দিয়েই গড়ে উঠেছে তার রাজনৈতিক পরিচয়।
১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট দিনাজপুরে জন্ম নেওয়া খালেদা জিয়া রাজনীতিতে আসবেন—এমন পূর্বাভাস তার শৈশব বা যৌবনে খুব কমই ছিল। তিনি ছিলেন একজন গৃহিণী, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সহধর্মিণী। কিন্তু ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমানের নির্মম হত্যাকাণ্ড তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ব্যক্তিগত শোককে শক্তিতে রূপান্তর করে তিনি রাজনীতির কঠিন ময়দানে পা রাখেন—যা বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিরল এক দৃষ্টান্ত।
স্বৈরশাসক এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে তার নেতৃত্ব তাকে গণতন্ত্রকামী মানুষের আস্থার প্রতীকে পরিণত করে। ১৯৯১ সালে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর তিনি দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন। এরপর আরও দুইবার প্রধানমন্ত্রী হন। এই দীর্ঘ সময়জুড়ে তার শাসনামল যেমন প্রশংসিত হয়েছে, তেমনি সমালোচনাও হয়েছে—এটাই গণতান্ত্রিক রাজনীতির স্বাভাবিক বাস্তবতা।
তার রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিক ছিল আপসহীনতা। বন্ধু যেমন কম ছিল না, তেমনি শত্রুও ছিল অসংখ্য। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সঙ্গে তার সম্পর্ক বরাবরই ছিল তীব্র দ্বন্দ্বপূর্ণ। অনেকের কাছে তিনি ছিলেন দৃঢ়চেতা নেত্রী, আবার অনেকের চোখে কঠোর ও অনমনীয়। তবে একথা অস্বীকার করার উপায় নেই—তিনি ছিলেন সিদ্ধান্তে অটল।
কারাবরণ, অসুস্থতা ও দীর্ঘ রাজনৈতিক নিষ্ক্রিয়তা তার জীবনের শেষ অধ্যায়কে বেদনাদায়ক করে তুললেও, তার অবদান ম্লান হয়নি। রাষ্ট্রক্ষমতায় না থেকেও তিনি বিরোধী রাজনীতির প্রতীক হয়ে ছিলেন বহু বছর। গণতন্ত্র, ভোটাধিকার ও বহুদলীয় রাজনীতির প্রশ্নে তার অবস্থান তাকে ইতিহাসে আলাদা আসনে বসিয়েছে।
বেগম খালেদা জিয়ার জীবনবৃত্তান্ত আমাদের শেখায়—রাজনীতি শুধু ক্ষমতার হিসাব নয়, এটি সাহস, ধৈর্য ও ত্যাগেরও নাম। তার জীবন নিয়ে মতভেদ থাকবে, বিতর্ক থাকবে; কিন্তু ইতিহাস তাকে উপেক্ষা করতে পারবে না। তিনি ছিলেন এবং থাকবেন বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার এক অনিবার্য নাম।
