রেহানা ফেরদৌসী
১৮ বছর পূর্ণ হওয়া অর্থ সে একটি নতুন জগতে পা দিচ্ছে। যে জগত আরেকটু বড়দের জগত। ”স্পুন ফিডিংয়” এর সময় শেষ। তাকে এখন বাহিরের দুনিয়ার জন্য তৈরি হতে হবে।

কবি সুকান্তর ভাষায়, আঠারো বছর বয়সে স্পর্ধায় মাথা তোলবার ঝুঁকি নেওয়ার কথা রয়েছে। আবার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইনের ভাষায় আঠারোই হলো অধিকার দাবি করে মাথা তোলার সময়। বয়স আঠারো পূর্ণ মানেই হলো শিশুর আওতা থেকে মুক্ত হয়ে পূর্ণবয়স্কের মর্যাদা পাওয়া। আন্তর্জাতিক আইন তা-ই বলে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক আইন অনুসরণ করে দেশের আইনে আঠারো বছর হলে সাবালক হওয়ার স্বীকৃতি দিয়েছে।

বয়স যখন আঠারোতে পা দিল, কিশোর বয়স তখন শেষ হলো। আর আঠারো-উনিশে পা দিতেই ছেলেমেয়েদের চলাফেরা, সাজ পোশাকটাও হয় অন্যদের থেকে একটু আলাদা। কৈশোরের দুর্দান্ত স্বভাব পেরিয়ে এই সময় তরুণ-তরুণীদের মধ্যে আসে কিছু পরিবর্তন। এই সময়টা তারা সবকিছুতেই নিজেকে একটু আলাদাভাবে উপস্থাপন করতে চায়। শারীরিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন ঘটে মনেরও। বিশেষ করে নিজেকে সবার মাঝে কীভাবে একটু আলাদা করে উপস্থাপন করবে, সবার নজর কাড়বে অন্যভাবে এই ব্যাপারগুলো কাজ করে এই বয়সটাতে। তবে ছেলেমেয়ে উভয়েই যেন শালীন থাকে সে ব্যাপারে পরিবারকে একটু খেয়াল রাখতে হবে। কারণ এই বয়সটাই যেন একটু অদম্য।

আঠারো বছর পূর্ণ হওয়ার অর্থ হল “প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার বয়সে” পৌঁছানো এবং আইনের দৃষ্টিতে তাকে একজন প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে বিবেচনা করা হয় । এই নতুন মর্যাদা অনেক নতুন স্বাধীনতা এবং দায়িত্বের উন্মোচন করে। আইন অনুযায়ী তিনি একজন পূর্ণবয়স্ক নাগরিক। রাষ্ট্র তাঁকে তাঁর ভোট দেওয়ার ক্ষমতা দেয়। জাতীয় পরিচয়পত্র বা স্মার্টকার্ড ইস্যু করা হয় তাঁর নামে। নাগরিক হিসেবে তাঁর সব অধিকার কিংবা দায়-দায়িত্ব তাঁকে অর্পণ করা হয়। ড্রাইভিং লাইসেন্স, ব্যাংকে নিজের নামে অ্যাকাউন্ট খোলা থেকে শুরু করে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সেবা গ্রহণের অধিকার তাঁর জন্মায় স্বাধীনভাবে। আর সন্তান হিসেবে তিনি তখন সাবালক। তাই তাঁর নিজের অধিকার সম্পর্কে নিজেই মতামত নিতে পারেন। চাকরি,পড়াশোনা প্রভৃতি বিষয়ে নিজে আইন অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিলে তা বৈধ(ছেলেদের ক্ষেত্রে বিবাহ ব্যাতিত)। মা-বাবাকে তখন বুঝতে হবে, সন্তানের আইনগত সত্তার এবং মতামতের গুরুত্ব দিতে হবে। আইনের চোখে তখন সন্তান তো একজন বৈধ নীতিনির্ধারকও। সন্তানের নামে জমি থাকলে তা আঠারোতেই সন্তানকে হস্তান্তর করতে হবে। সে দাবি করলে অস্বীকার করা যাবে না।

তাই বলে বয়স আঠারো হলে কি যা ইচ্ছা তা করা যায়? এর উত্তর হচ্ছে ‘না’। চাইলেই যা ইচ্ছা করা যায় না। তখন আইনি বাধ্যবাধকতার আওতায় চলে আসে। যেমন এ বয়সের আগে যদি কেউ কোনো অপরাধ করে তা শিশু আইনে বিচার হলেও এবং কিছু সুযোগ-সুবিধা পেলেও, আঠারো পূর্ণ হওয়ার মানেই দেশের অন্যান্য নাগরিকের যে আইন মানতে হবে, তাঁকেও সে আইনের আওতায় আসতে হবে। মাদকে অভ্যস্ত হলে, নারী নির্যাতন করলে কিংবা অন্য যেকোনো বেআইনি কাজ করলে তাঁকে পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তির মতো শাস্তি পেতে হবে।

আর একটা বিষয়, প্রাপ্তবয়স্ক হলেও তাঁর নিজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে মা-বাবার মতামতকে একদম উড়িয়ে দিলে চলবে না। আইনের সঙ্গে সঙ্গে নৈতিকতাবোধও পাকাপোক্ত থাকতে হয়। নাবালক সন্তান যেমন মা-বাবার কাছ থেকে ভরণপোষণ পায়, তেমন করে সন্তান প্রাপ্তবয়স্ক হলে বয়স্ক এবং কর্মহীন বাবা-মাকে উল্টো ভরণপোষণ দিতে হবে।

পাশাপাশি অন্যান্য কিছু দায়িত্ব তাকে দিতেও হবে। যেমন ছোটো ভাইবোনদের দেখাশুনা, পড়ানো, বাসার টুকটাক সমস্যা সমাধান করা। এতে যে দায়িত্ববোধ তৈরি হবে, তা সারাজীবনের অমূল্য শিক্ষা হয়ে ওকে আলো দেখাবে। সপ্তাহে একদিন অন্তত বাজারে পাঠাতে হবে। আমাদের পুরো জীবন নানারকম বোঝাপড়ার মধ্যে যেতে হয়। আলোচনা করতে হয়। বাজারে দরদাম করা হচ্ছে, সেই নেগোসিয়েট বা আলোচনা শেখার প্রাথমিক বিদ্যালয়। সম্ভব হলে কিছু রোজগার করার দায়িত্ব দিতে হবে। যেমন টিউশনি। টিউশনি না হলে অন্য কাজও করতে পারে। যেমন প্রোগ্রামিং, ফটোগ্রাফি ইত্যাদি। সংসারে হয়ত তার রোজগারের প্রয়োজন নেই, কিন্তু এটা তাকে স্বনির্ভরশীলতা শেখাবে। সবচে বড় কথা, নিজে আয় করলে টাকার মূল্য বুঝবে।

এটি গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক শিক্ষা। এসময় তার মন বিপরীত লিঙ্গের প্রতি রোমান্টিকতা তৈরি হবে। এটা এ বয়সের ধর্ম। তাই তাকে খোলাখুলি বুঝিয়ে বলতে হবে এর কারণে ওর কী কী সমস্যা হতে পারে। বিভিন্ন ব্যাপারে তার মতামত নিন। বিশেষ করে পারিবারিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়। এতে সে সিদ্ধান্ত নিতে শিখবে। যা তার জীবনে অনেক কাজে লাগবে। প্রকৃত বড় মানুষের সান্নিধ্যে নিয়ে যেতে হবে। মহৎ সান্নিধ্য খুব ভালো টনিক। এটি তার মধ্যে খুব ভালো প্রভাব ফেলবে। মনে রাখতে হবে, বিখ্যাত মানুষ মানেই বড় মানুষ নন।মা-বাবা তাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ ঘটনাগুলো তাকে বলতে হবে। সেরা মুহূর্তগুলোর গল্প শোনাতে হবে। বাস্তব জীবনের সত্য ঘটনার মতো প্রেরণা আর কিছু নেই। মা-বাবার সবচে বিশ্বস্ত বন্ধু বা আত্মীয়ের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে তাকে সাহায্য করতে হবে। কঠিন পৃথিবীতে এধরনের সম্পর্ক খুব দরকার। অভিভাবকদের অকৃত্রিম বন্ধু/ আত্মীয়দের সাথে পরিচয় থাকলে সে দরকারে তাদের কাছে যেতে পারবে। পরিবারের অবর্তমানে সে আপনজন খুঁজে পাবে।

এ সময় তার সাথে সমস্যা ভাগ করার সময়। আমরা সন্তানদের কাছ থেকে সমস্যা গোপন রাখি। কিন্তু আঠারো তে তা করা ঠিক নয়। সমস্যাগুলো জানলে তারা সেটা অনুধাবণ করতে পারবে এবং এটা হলে তারা সহজে পথভ্রষ্ট হবে না। মা-বাবার দুঃখ যারা বোঝে তারা খারাপ হয় না। তবে বলার মাত্রায় সীমা বজায় রাখতে হবে।যেনো সমস্যা জেনে সে হতাশ না হয়ে পড়ে।

১৩ বছর বয়সে বাদশা আকবর মোঘল সাম্রাজ্যের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। কিন্তু ১৮ পূর্ণ হওয়া মানুষটিকে মোঘল সাম্রাজ্যের দায়িত্ব নিতে হবে না। তাকে তার নিজের জীবনের দায়িত্ব নেওয়া শুরু করতে হবে। এবং সেটা শুরু করার এখনই শ্রেষ্ঠ সময়।

লেখক : সহ সম্পাদক, সমাজকল্যাণ বিভাগ,
পুলিশ নারী কল্যাণ সমিতি
(কেন্দ্রীয় পুনাক)

Share.
Leave A Reply

Home
News
Notification
Search
Exit mobile version