খাজুরা সংবাদদাতা
আজ ৭ ডিসেম্বর। ঐতিহাসিক খাজুরা মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে যশোরের খাজুরা মুক্ত হয়। রাতভর খণ্ড খণ্ড আক্রমণের পর ছয়জন মিত্র বাহিনীর সদস্যের জীবনের বিনিময়ে মুক্ত হয়েছিল খাজুরা মনিন্দ্রনাথ মিত্র মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের রাজাকার ক্যাম্প। পাক বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার বাহিনীর হত্যা, লুট ও নির্যাতনের হাত থেকে মুক্তি পায় এই অঞ্চলের মুক্তিকামী মানুষজন।
জানা যায়, তৎকালীন যশোর ক্যান্টমেন্ট রাজাকার ঘাঁটি ধ্বংসের পরদিনই খাজুরার এই শক্ত ঘাঁটি ধ্বংস করে মুক্তি ও মিত্র বাহিনীর সদস্যরা। কিন্তু শক্র মুক্ত হওয়ার আগেই মিত্র বাহিনীর ছয় সদস্যের জীবন কেড়ে নেয় পাষণ্ড রাজাকারেরা। ৬ ডিসেম্বর যশোর মুক্ত করার রাতেই মুক্তি ও মিত্র বাহিনীর সদস্যদের লক্ষ্য ছিল খাজুরা রাজাকার ক্যাম্পটি দখল করার। পরিকল্পনা অনুযায়ী ওই রাতেই ক্যাম্পটি ঘিরে ফেলে মিত্র বাহিনীর সদস্যরা। কিন্তু এর আগে যশোর মুক্ত হওয়ার সংবাদ শুনে অনেক রাজাকার সদস্য ক্যাম্পে হাজির না হয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। যে কারণে মুক্তি বাহিনীর সদস্যদের সেদিন ক্যাম্প আক্রমণ করাটা সহজ হয়েছিল।
ঐতিহাসিক যশোর হানাদার মুক্ত দিবস উদযাপন
রাত ঘনীভূত হওয়ার পরপরই আক্রমণ শুরু করে মিত্র বাহিনী। একের পর এক আক্রমণ করেও রাজাকারদের ঘায়েল করতে পারেনি। চারপাশে প্রাচীর ঘেরা ছিল, সেজন্য ক্যাম্পটিতে আক্রমণ করতে বারবার বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল মুক্তি বাহিনীর সদস্যরা। তারপরও শক্র পক্ষকে ঘায়েল করতে প্রাণপন চেষ্টা চালায় তারা এবং উল্টোদিক থেকে পাল্টা গুলি চালায় রাজাকার ও পাক বাহিনীর সদস্যরা।
এদিকে, ভোর পেরিয়ে সকাল ৯টা পর্যন্ত যুদ্ধ চলার পর কোন পক্ষই কাউকে ঘায়েল করতে না পারায় পার্শ্ববর্তী লেবুতলা মুক্তি বাহিনীর ক্যাম্পে ট্যাংক রেখে কিছু মিত্র বাহিনীর সদস্যরা খাজুরা রাজাকার ক্যাম্পে আসেন। এ সময় তারা খাজুরা মনিন্দ্রনাথ মিত্র মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দক্ষিণ প্রাচীরের পাশে দাঁড়িয়ে পাক বাহিনীকে আত্মসমর্পণ করতে বলেন। তখন ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে রাজাকার ক্যাম্পের সদস্যরাও ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে আত্মসমর্পণের কথা বলে মুক্তি ও মিত্র বাহিনীদের প্রাচীরের ভেতরে প্রবেশ করতে বললে শত্রু পক্ষের দূরভিসন্ধির কথা না ভেবেই মুক্তি ও মিত্র বাহিনীর ১০ থেকে ১২ জনের একটি চৌকস দল ভিতরে প্রবেশ করা মাত্রই বিদ্যালয়ের প্রাচীর ঘেসে লুকিয়ে থাকা রাজাকারের দল তাদেরকে লক্ষ্য গুলি বর্ষণ করে। সাথে সাথে পাখির মত ঝরে পড়ে নাম না জানা ছয়জন মিত্র বাহিনীর সদস্যের জীবন। রক্তে রঞ্জিত হয় খাজুরার মাটি। সহযোদ্ধাদের তরতাজা জীবন রক্ষা করতে না পেরে হতবিহ্বল হয়ে পড়ে মুক্তি বাহিনীর সদস্যরা।
খবরটি পার্শ্ববর্তী লেবুতলা ক্যাম্পে পৌঁছানো মাত্রই ছুটে আসে মুক্তি বাহিনীর চৌকস একটি দল। এ সময় মুক্তি ও মিত্র বাহিনী যৌথভাবে স্কুলের প্রাচীর ভেঙে ভিতরে ঢুকে পড়ে। ট্যাংকের চাপায় ও মর্টারের মুহুর্মুহু গুলিতে পরাস্ত করে হানাদার বাহিনী ও দেশিয় নরপিশাচ রাজাকারদের। দিকবিদিক পালাতে থাকে রাজাকার সদস্যরা। অনেকেই পার্শ্ববর্তী চিত্রা নদীতে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতরিয়ে ওপারে পালিয়ে যায়। এ সময় মুক্তি ও মিত্র বাহিনীর আক্রমণের সাথে যুক্ত হয় স্থানীয় সাধারণ মানুষ। চারিদিকে শুরু হয় বিজয় উল্লাস। খাজুরা এলাকার আকাশে স্বাধীনতার লাল-সবুজ পতাকা উড়িয়ে আনন্দ উল্লাস করে মুক্তিকামী হাজার হাজার মানুষজন।
এদিকে, দিবসটি উদযাপন উপলক্ষ্যে আজ নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে শহিদ মুক্তি ও মিত্র বাহিনী স্মৃতি পরিষদ। দিনব্যাপি কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে, খাজুরা মনিন্দ্রনাথ মিত্র মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পশ্চিমে নির্মিত দেশের একমাত্র মুক্তি ও মিত্র বাহিনী স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ, র্যালি, আলোচনা সভা ও দোয়া অনুষ্ঠান।
