শরণখোলা সংবাদদাতা
১৮ ডিসেম্বর ১৯৭১ বাগেরহাটের শরণখোলা হানাদারমুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে দেশ স্বাধীন হলেও ৯ নম্বর সেক্টরের সুন্দরবন সাবসেক্টরের শরণখোলা ছিল হানাদার বাহিনীর দখলে। তৎকালীন থানা সদর রায়েন্দা বাজারে মুক্তিবাহিনী এবং রাজাকারদের মধ্যে সম্মুখযুদ্ধ চলে তখনও। ১৪ ডিসেম্বর থেকে ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত টানা চার দিন সম্মুখযুদ্ধে রাজাকারের বুলেটে শহীদ হন গুরুপদ, টিপু সুলতান, আসাদুজ্জামান, আলাউদ্দিন, আলতাফ হোসেনসহ পাঁচ বীরযোদ্ধা।

১৮ ডিসেম্বর পুরোপুরিভাবে হানাদার মুক্ত হয় মুক্তিযুদ্ধের ৯ নম্বর সেক্টরের সুন্দরবন সাব-সেক্টরের শরণখোলার রণাঙ্গন। সকাল ১০টার দিকে থানা ভবনে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করে শরণখোলাকে আনুষ্ঠানিকভাবে হানাদারমুক্ত ঘোষণা করেন সুন্দরবন সাবসেক্টরের কমান্ডার মেজর (অব.) জিয়া উদ্দিন আহমেদ। এদিন বিকেল চারটার দিকে রায়েন্দা পাইলট হাই স্কুল মাঠে চার শহীদের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। পরে রায়েন্দার আরকেডিএস বালিকা বিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকায় সমাহিত করা হয় তাদেরকে। প্রথম শহীদ গুরুপদকে সমাহিত করা হয় সুন্দরবন সংগ্ন সাউথখালী ইউনিয়নের সোনাতলা গ্রামের পানিরঘাট এলাকায়।

সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের তথ্যমতে, শেষ মুহূর্তে হানাদার বাহিনী আওয়ামী লীগের তৎকালিন সভাপতি নাছির উদ্দিন আকনের রায়েন্দা বাজারস্থ বাসভবন দখল করে। এটিই ছিল রাজাকারদের প্রধান ক্যাম্প। এছাড়া থানা ভবন ও রায়েন্দা ইউনিয়ন পরিষদ ভবন দখল করে আরো দুটি ক্যাম্প স্থাপন করে শত্রু বাহিনী।

সুন্দরবনসহ শরণখোলাকে হানাদারমুক্ত করতে দীর্ঘ ৯ মাসের সেই রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের নেতৃত্বে ছিলেন সাবসেক্টর কমান্ডার মেজর জিয়া উদ্দিন আহমেদ এবং সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা শামছুল আলম তালুকদার। রায়েন্দা বাজারের শেষ যুদ্ধে পূর্বাঞ্চল এবং পশ্চিমাঞ্চল নামে দুটি দল গঠন করা হয়। পূর্বাঞ্চল দলের কমান্ডিং অফসিার ছিলেন যুদ্ধকালীন ইয়াং অফিসার ও স্টুডেন্ট ক্যাম্প কমান্ডার হেমায়েত উদ্দিন বদশা এবং পশ্চিমাঞ্চল দলের কমান্ডিং অফিসারের দায়িত্বে ছিলেন মোরেলগঞ্জের আব্দুল গফ্ফার সুবেদার। এই দুটি দলের আট শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা রায়েন্দা বাজারের রাজাকারদের তিনটি ক্যাম্পে আক্রমণ করেন।

পূর্বাঞ্চল দলের কমান্ডিং অফিসার বীর মুক্তিযোদ্ধা হেমায়েত উদ্দিন বাদশা বলেন, আমরা ১৪ ডিসেম্বর দুপুর ১টা ৪৫মিনিটের সময় ফায়ার ওপেন করি। রামপালের সহযোদ্ধা শ্যামল ছিলেন এলএমজির কভারিং ফায়ারের দায়িত্বে। শ্যামল ওপর থেকে রাজাকার ক্যাম্প লক্ষ্য করে ফায়ার করতে থাকেন। আর অগ্রবর্তি দলের ২০-২৫ জন যোদ্ধা নাছির উদ্দিন আকনের বাসভবনের রাজাকার ক্যাম্পের দিকে অগ্রসর হন। প্রথম দিন (১৪ ডিসেম্বর) যুদ্ধ শুরু হওয়ার পাঁচ মিনিটের মাথায় রাজাকারের বুলেটে শহীদ হন গুরুপদ। গুলিতে তার মাথার খুলি উড়ে যায়। এদিন বিকেল চারটা থেকে সাড়ে চারটার মধ্যে শহীদ হন টিপু সুলতান ও আসাদুজ্জামান। রাতে শহীদ হন আলাউদ্দিন। ১৫ ডিসেম্বর সকালে শহীদ হন আলতাফ হোসেন। ওই দিন থানা ভবন ও ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের রাজাকার ক্যাম্প দখলে নেই আমরা।

কমান্ডিং অফিসার হেমায়েত উদ্দিন বাদশা আরও বলেন, ১৬ ও ১৭ ডিসেম্বর আক্রমণ চালাই নাছির উদ্দিনের বাসভবনের প্রধান ক্যম্পে। এ সময় দিন-রাত সমানতালে ওই ক্যাম্পে মটার শেল ও গুলিবর্ষণ করি। পাল্টা গুলি চালায় রাজাকাররাও। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মুক্তিবাহিনীর গুলির মুখে নিশ্চিত পরাজয় বুঝতে পেরে ১৭ ডিসেম্বর রাতেই বেশিরভাগ রাজাকার ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে যায়। ক্যাম্প সংলগ্ন রায়েন্দা খালের সঙ্গে সংযুক্ত প্রায় ১০০ ফুট দীর্ঘ গোপন সুড়ঙ্গ পথে পালিয়ে যায় তারা। এর পর ১৮ ডিসেম্বর সকাল ৯টা পর্যন্ত কোনো পাল্টা আক্রমণ না আসায় ক্যাম্পে ঢুকে যায় মুক্তিবাহিনী। সেখানে ১৭-১৮ জন রাজাকারকে জীবিত অবস্থায় পাওয়া য়ায়।

Share.
Exit mobile version