রেহানা ফেরদৌসী
যে কোনও সম্পর্ক তৈরি করতে অনেক সময় জটিলতা পোহাতে হয়। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষই হয়তো জানেন না, সম্পর্কে যাওয়ার পর শুরু হয় আসল চ্যালেঞ্জ। সম্পর্ক তৈরির চেয়েও তা টিকিয়ে রাখা বেশি কঠিন। এক্ষেত্রে মানুষকে নানা ধরনের প্রতিকূলতা পার করে সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়। দুটি মানুষ পরস্পরের সঙ্গে মিলে মিশেই এই চ্যালেঞ্জ নিতে পারেন। একটানা একই কাজ করতে যেমন একঘেয়েমি চলে আসে, তেমনি দীর্ঘদিনের কোনো সম্পর্কও অনেক সময় কোনো না কোনো পর্যায়ে এসে একঘেয়ে লাগতে পারে। সেটি দাম্পত্য জীবনের যে কোনো সময় হতে পারে।
সম্পর্কের শুরুর সময়টা হল দারুণ মজার। এই সময়টা দ্রুত কেটে যায়। মানুষ এই সময়ে নিজেদের জানতে শুরু করেন। সম্পর্ক যত পুরনো হতে থাকে, তত বেশি সমস্যা দেখা যায়, একঘেয়েমি চলে আসে। এক্ষেত্রে প্রথমের দিনগুলিতে যেই আনন্দ ছিল, তা আর থাকে না। বিবাহিত জীবন আনন্দের হওয়া জরুরি। মানুষ সুখে থাকার আশায় বিয়ের মতো বন্ধনে জড়ায়। কিন্তু কখনো বিবাহিত জীবন একঘেয়ে হয়ে ওঠে। এখানে একপাক্ষিকভাবে কাউকে দোষারোপ করে লাভ নেই। কারণ দু’জনের ছোট ছোট ভুল কিংবা অবহেলায় এক সময় বাড়ে দূরত্ব, সম্পর্কে চলে আসে একঘেয়েমি। একইভাবে দিন কাটাতে থাকলে একটা সময় বিরক্তির জন্ম নেবে। তাই সম্পর্ক যতই পুরনো হোক, তাতে নতুনত্ব রাখতে হবে। দু’জন দু’জনকে মুগ্ধ করার মতো প্রচেষ্টা থাকতে হবে। নয়তো একটা সময় একঘেয়েমি এসে ভর করবে। তাই এ ধরনের পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে প্রচেষ্টা চালাতে হবে দু’জনকেই।
বর্তমান বেশিরভাগ দম্পতিই চাকুরিজীবী। যে কারণে ঘরের বাইরেই দুজনের অনেকটা সময় কেটে যায়। দিন শেষে পরস্পরকে সময় দেওয়ার মতো সময় আর তাদের থাকে না। এর প্রভাব পরে সম্পর্কে। একটা সময় তৈরি হয় দূরত্বের। প্রতিদিন একই রুটিন, একই অভ্যাসের কারণে সম্পর্কে চলে আসে একঘেয়েমি। তাই যত ব্যস্ততাই থাকুক, পরস্পরকে সময় দিন। ভালোবাসার অনুভূতি কথায় প্রকাশ না করতে করতে, একটা সময় ভালোবাসার কথা মুখে প্রকাশ করার কথা ভুলে যান। মনে যতই ভালোবাসা থাকুক, মুখে অবশ্যই জানাতে হবে। কারণ মানুষ কখনো আরেকজনের মন পড়তে পারে না। তাই মনের কথা মুখেও জানান। আপনার জীবনসঙ্গীকে ভালোবাসার কথা জানান। আপনার মুখের দু’টি সুন্দর কথা তার দিনটিও সুন্দর করে দিতে পারে। কেটে যেতে পারে একঘেয়েমির মেঘ। বিভিন্ন কষ্টের কারণে জীবন থেকে হাসি-আনন্দ মুছে ফেলে অনেকে সব সময় মন খারাপ করে রাখেন। সবকিছুতেই একে অপরের নেতিবাচকতা খুঁজে বেড়ান। এমন বিষাক্ত কথা শুনে নিজের জীবন নিয়েও থাকেন না সন্তুষ্ট। একই রুটিনে চলতে থাকে নিরানন্দ জীবন।
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঘনিষ্ঠতা থাকা জরুরি। তাই পরস্পরের কাছাকাছি থাকুন। এতে সম্পর্কে উষ্ণতা বজায় থাকবে। দু’জন দু’জনের প্রতি আকর্ষণ ধরে রাখতে নিজেকে সুস্থ ও আকর্ষণীয় করে রাখুন। এতে ঘনিষ্ঠতা থাকবে এবং একঘেয়েমি দূর হবে। দু’জনের প্রতিদিনের মনোমালিন্য একটা সময় বড় অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বিবাহিত জীবনে। পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ কমে যাবে। তৈরি হবে বিতৃষ্ণা। একটা সময় সহ্য হবে না একে অন্যকে। তাই ছোট ছোট বিষয় এড়িয়ে চলুন। ছাড় দিতে শিখুন। এটি দু’জনের জন্যই জরুরি। গাছের জন্য যেমন পানি আর সূর্যের আলো দরকার, তেমনি একটি সুন্দর সম্পর্কের জন্য দরকার সময়, পারস্পরিক শ্রদ্ধা, ভালোবাসা এবং বিশ্বাস ।
এখন যার সঙ্গে সম্পর্কটা একঘেয়ে মনে হচ্ছে, একটা সময় তার সঙ্গে নিশ্চয়ই চমৎকার সময় কাটিয়েছেন। দুজন মিলে মাঝেমাঝে সেই পুরোনো স্মৃতির জগতে হারিয়ে যান। পুরনো উপহারগুলো বের করুন, প্রিয় জায়গাগুলোতে আবার একসঙ্গে ঘুরে আসুন, পুরনো ছবিগুলো একসঙ্গে দেখুন। একসঙ্গে দেখা করতে পারেন পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গেও, যাদের সঙ্গে আপনাদের দারুণ সব স্মৃতি জমে আছে।
জীবনসঙ্গীকে খুশি রাখার জন্যে তার প্রশংসা করুন,একান্তে করুন,সকলের সামনেও করুন।ছোট ছোট কাজের জন্য বা কোনো প্রাপ্তির জন্য তাকে অভিনন্দন জানান,কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করুন।প্রশংসা করার জন্য বড় কোনো কারণ যে দরকার সেটি কিন্তু নয়। ‘আজ তোমাকে সুন্দর লাগছে’, বা ‘তুমি দারুণ করেছ’ এই ছোট বাক্যগুলোই সম্পর্কের মোড় ঘোরানোর জন্য যথেষ্ট। পেছনে ফিরে দেখুন, সম্পর্কটা যখন নতুন ছিল তখন কিন্তু সঙ্গীর প্রশংসা অনেক করতেন। এ বিষয়টি আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসুন জীবনে।
বিবাহিত জীবনে সব ক্ষেত্রেই সঙ্গীকে অযথা নিয়মকানুনে বেঁধে ফেলতে চাইলে সম্পর্কে একসময় ফাটল ধরতে শুরু করে। শুরুর দিকে এগুলোর সঙ্গে অনেকেই মানিয়ে নেন, তবে একটা সময় গিয়ে আর পারেন না। ফলে সম্পর্ক আর আগের মতো আগ্রহ থাকে না। মনে রাখবেন, আপনার সঙ্গীর আপনার মতোই নিজস্ব একটি জগৎ আছে। সবকিছু নিজের মতো চাইবেন না। তার ইচ্ছার গুরুত্ব দিন ও ছাড় দিন।
দাম্পত্যের শুরুর দিকে সঙ্গীকে সময়ে-অসময়ে কত উপহার আর সারপ্রাইজই না দিতেন। এখন আর আগের সুর নেই, সেই হুটহাট উপহারেরও বালাই নেই, এমনকি বিশেষ দিবস ছাড়া ফুলের কোন প্রাপ্তি নেই। আরেকবার শুরু করে দেখতে পারেন বিষয়টি। উপহার যে খুব দামি হতে হবে তা নয়। দিনশেষে সঙ্গীর জন্য তার প্রিয় ফুল নিয়ে বাড়ি ফেরা কিংবা অনেকদিন পর সঙ্গীর প্রিয় খাবারটি রান্না করার মতো উপহারই হারানো ছন্দ ফেরানোর কাজ করতে পারে। পাশাপাশি এই একঘেয়েমি দূর করতে দুজনে মিলে নতুন শখ তৈরি করা, একসাথে কোথাও ঘুরতে যাওয়া, একে অপরের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা এবং নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ বাড়ানো জরুরি। মোবাইল বা অন্যান্য ডিজিটাল ডিভাইস থেকে কিছু সময়ের জন্য দূরে থেকে একে অপরের সাথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করুন। এই অভ্যাসগুলো দাম্পত্য জীবনে একঘেয়েমি কাটিয়ে উঠতে এবং সম্পর্ককে আরও মধুর ও দৃঢ় করতে সাহায্য করবে।
যদি কিছুতেই কিছু না হয়, সম্পর্কের একঘেয়েমি না কাটে, তবে কিছুদিনের জন্য নিজেদের মতো একান্তে দিন কাটাতে পারেন। নিজেকে সময় দিন, প্রিয় বইটা পড়ে ফেলুন, অনেকদিন ধরে না করা কাজটা করে ফেলুন, বন্ধুদের সময় দিন। একটা বিরতি দিয়ে আবার ফিরুন একে অপরের কাছে। এবার হয়তো একঘেয়েমি কেটে যাবে অনেকটাই।
আপনার বিবাহজীবন কে সুস্থ ও সফল রাখার জন্য আপনার জীবনসঙ্গীর প্রতি বিশ্বস্ত থাকা এবং কথা বলা অন্যতম সেরা উপায় । আপনার অনুভূতি সম্পর্কে সৎ থাকুন। কথোপকথনের সময় হোক তা সামনাসামনি অথবা দূরালাপনে, সব সময় সদয় এবং শ্রদ্ধাশীল হোন। ভালো যোগাযোগের অন্যতম অংশ হল একজন ভালো শ্রোতা হওয়া এবং আপনার জীবনসঙ্গী আপনার কাছ থেকে কী চান এবং কী প্রয়োজন তা বোঝার জন্য সময় নেওয়া।
লেখক : সহ সম্পাদক, সমাজকল্যাণ বিভাগ,
পুলিশ নারী কল্যাণ সমিতি
(কেন্দ্রীয় পুনাক)
