সংক্রমণ ঝুঁকি সত্ত্বেও চিকিৎসকদের মানবিকতার দৃষ্টান্ত
বাংলার ভোর প্রতিবেদক
যশোরে একজন এইডস রোগী সন্তান জন্ম দিয়েছেন। সংক্রমণ ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও মানবিক দিক বিবেচনায় রোববার ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে তার অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে একটি ছেলে সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করে ঝুঁকিপূর্ণ অস্ত্রোপচারটি সফলতার সাথে সম্পন্ন করেছেন চিকিৎসকরা। নিরাপত্তার জন্য পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে হাসপাতালের গাইনি রোগীদের জন্য নির্ধারিত অস্ত্রোপচার কক্ষটি দুই দিন বন্ধ থাকবে। এই রোগীর চিকিৎসা নিয়ে হাসপাতালের স্বাস্থ্যসেবাদানকারীরা দ্বিধা-বিভক্তিতে পড়েন চিকিৎসকেরা। একদিকে অন্তঃসত্ত্বার চিকিৎসাপ্রাপ্তির মানবিক চাহিদা; অন্যদিকে অন্য রোগীদের সংক্রমণ ঝুঁকি ও সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক-নার্সদের নিরাপত্তার বিষয়টি জড়িত।
যশোর হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, হাসপাতালটিতে এইডস রোগীর চিকিৎসার জন্য অ্যান্টিরেট্রোভাইরাল থেরাপি (এআরটি) সেন্টার রয়েছে। এই সেন্টারের অধীনে যশোরসহ আশেপাশের জেলার এক শ’ এইচআইভি রোগী রয়েছে। তার মধ্যে রোববার সন্তান প্রসব করা নারীও একজন। এই রোগী যখন ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন, তখন অ্যান্টিরেট্রোভাইরাল থেরাপি সেন্টারের কর্মকর্তারা বিষয়টি হাসপাতালের তত্বাবধায়ককে জানান। এরপর বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার পরে গত দুই মাস আগে নারীর অস্ত্রোপচার প্রয়োজন হবে বলে গাহনি চিকিৎসকেরা পরামর্শ দেন। কিন্তু এইডসে আক্রান্ত এই রোগীর অস্ত্রোপচার এই হাসপাতালে করা হলে পরবর্তী তিন দিন অপারেশন থিয়েটারের কার্যক্রম বন্ধ রাখতে হবে।
এ নিয়ে অন্যান্য বিভাগের চিকিৎসকদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। পরামর্শ দেওয়া হয়, এইডসে আক্রান্ত প্রসূতিকে বিশেষায়িত হাসপাতালে স্থানান্তরের। কিন্তু প্রসূতি রোগি আর্থিকভাবে দরিদ্র। ওই চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করার সামর্থ নেই। যে কারণে মানবিক দিক বিবেচনায় নিয়ে অস্ত্রপচারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। গাইনি বিভাগের একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের নেতৃত্বে সাত সদস্যের একটি চিকিৎসক দল অস্ত্রোপচার সম্পন্ন করেন রোববার বেলা ১২টার দিকে। সকাল ১০টায় অস্ত্রোপচার শুরু হয়। অস্ত্রোপচারে স্বাভাবিক ও সুস্থ্য বাচ্চাদের মতো ওজন হয়েছে। সুস্থ রয়েছেন নবজাতকটির মাও। তাদেরকে বিশেষ একটি ওয়ার্ডের কেবিনে রাখা হয়েছে। সাধারণ রোগীদের মতোই তাদের চিকিৎসা চলছে বলে জানিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তাদের সঙ্গে স্বামী, প্রসূতির মা বাবা ও নিকট আত্মীয় স্বজনেরা আসছেন।
জানতে চাইলে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক চিকিৎসক হোসাইন সাফায়েত বলেন, ‘সংক্রমণ ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও মানবিক দিক বিবেচনায় এইচআইভি ভাইরাসে আক্রান্ত অন্তঃসত্ত্বার অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। এই হাসপাতালের চারটি অপারেশন থিয়েটার (ওটি) কক্ষের একটি ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এ জন্য সাধারণ অস্ত্রোপচার আজ ও আগামি দুইদিন বন্ধ রাখা হয়েছে। গাইনিসহ জরুরি অস্ত্রোপচার অপর তিনটি ওটি কক্ষে করা হবে।
তিনি বলেন, এই হাসপাতালে প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০জন অন্তঃসত্ত্বা সন্তান প্রসব করেন। এ ছাড়া অন্যান্য অস্ত্রোপচার করা হয় আরও ১৫ থেকে ২০টি। অস্ত্রোপচারটি বিশেষায়িত হাসপাতালে করতে পারলে বেশি ভালো হতো। কিন্তু প্রসূতি আর্থিকভাবে দরিদ্র। ওই চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করার সামর্থ্য নেই। যে কারণে মানবিক দিক বিবেচনায় নিয়ে অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তা ছাড়া এই হাসপাতালে এর আগে এ রকম একজন রোগীর অস্ত্রোপচার হয়েছে। হাসপাতালে সে ধরনের সুরক্ষা ব্যবস্থা আছে।
তিনি বলেন, নবজাতকটি সুস্থ রয়েছে। এখানে আমার কোন ক্রেডিট নেই। ঝুঁকি নিয়ে আমার চিকিৎসকেরা ও তাদের সহযোগীরা এমন সাহসী কাজটি করেছে। শিশুটিকে আমরা অভারভেশনে রেখেছি। শিশুটির শরীরে ভাইরাসটি ছড়িয়েছে কিনা সেটা নিয়ে কাজ করা হচ্ছে।’
হাসপাতাল ও রোগীর স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এইডসে আক্রান্ত এই নারীর প্রথমে বিয়ে হয় বাঘারপাড়ার স্থানীয় এক যুবকের সঙ্গে। বিয়ের দেড় বছরের মধ্যে তাদের একটি ছেলে সন্তান হয়। জন্মের কিছুদিন পরেই শিশুটি মারা যায়। এর কয়েক মাস পরেই অজ্ঞাত রোগে মারা যায় তার স্বামীও। এর এক বছর পর ২০১৬ সালে বাঘারপাড়ার ওই নারীর বিয়ে হয় মনিরামপুর উপজেলার এক যুবকের সঙ্গে। বিয়ের পরে অ্যাপেন্ডিসাইটিস অপাসারনের সময়ে জানা যায় এই নারী এইচআইভি পজেটিভ। পরে এই নারীকে খুলনাতে অবস্থিত অ্যান্টিরেট্রোভাইরাল থেরাপি (এআরটি) সেন্টারের অধীনে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। চিকিৎসার পাশাপাশি তিনি প্রথমবারের মতো অন্তঃসত্ত্বা হন। এরপর তাকে সিজারের মাধ্যমে ছেলে সন্তান জন্ম দেন তিনি। সেই ছেলেটির বয়স এখন সাড়ে চার বছর। তার শরীরে কোন এইচআইভি ভাইরাসের অস্থিত্ব পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে চিকিৎসকেরা। এরপর দ্বিতীয় বারের মতো বছর খানিক আগে আবারও এই নারী অন্তঃসত্ত্বা হন। অ্যান্টিরেট্রোভাইরাল থেরাপি (এআরটি) যশোরের অধীনে এই নারীর চিকিৎসা চলছে।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, এই নারী এইচআইভি পজেটিভ হলেও তার স্বামী নেগেটিভ। কারণ হিসাবে তারা বলছেন, অ্যান্টিরেট্রোভাইরাল থেরাপির মাধ্যমে ভাইরাসটির মাত্রা কিছুটা কম। ফলে দৈহিক মিলনেও স্বামীর দেহে ছড়ায়নি। তবে এই নারীকে তৃতীয় বারের মতো সন্তান না দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন হাসপাতালের গাইনী বিভাগের চিকিৎসকেরা।