বাংলার ভোর প্রতিবেদক
যশোরের ৬টি সংসদীয় আসনের মধ্যে পাঁচটিতে প্রার্থী ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। অপর আসনটি শরীক দলের জন্য ছাড় দেয়া হতে পারে বলে গুঞ্জন রয়েছে। তবে বিএনপির ঘোষিত পাঁচটি আসনের মধ্যে শুধুমাত্র সদরে নির্ভার বিএনপি। নেতাকর্মীরা বলছে, বাকি আসনগুলোতে প্রার্থী বাছাই, মনোনয়নপ্রত্যাশীদের দ্বন্দ্ব, গ্রুপিংয়ে ডুবতে পারে বিএনপি। যদিও জেলার শীর্ষ নেতৃবৃন্দ বলছেন, দ্বন্দ্ব গ্রুপিং থাকলেও ভোটের আগে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আসন পুনরুদ্ধারে কাজ করবেন তারা। অন্যদিকে দলের ইমেজে এবার সকল আসনেই চমক দেখাতে চায় জামায়াত।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে যশোরের ছয়টি আসনে প্রায় ৩৫ জন নেতাকর্মী দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার জন্য তৃণমূলে কাজ শুরু করেন। এর মধ্যে সোমবার বিকেলে রাজধানীর গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ৬টি সংসদীয় আসনের মধ্যে পাঁচটিতে প্রার্থী ঘোষণা করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। নতুন মুখ হিসেবে প্রার্থী তালিকায় জায়গা করে নিয়েছেন ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণ। যশোর-৫ (মণিরামপুর) আসনের প্রার্থী ঘোষণা করা হয়নি। বিএনপির সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর মতে, এ আসনটি শরীক দলের প্রার্থীকে ছেড়ে দেয়া হতে পারে। প্রার্থী ঘোষিত হওয়ার পরে ধানের শীষ প্রতীকের পক্ষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার নির্দেশনা থাকলেও সদর ছাড়া জেলার বাকি আসনগুলোতে মনোনয়ন প্রত্যাশী নেতাদের মাঝে চলা অভিমানের বরফ এখনো গলেনি। ঐক্যবদ্ধ না হওয়াতে তৃণমূলে এখনো গ্রপিং দ্বন্দ্ব মেটেনি। ফলে অনেকটা ফুরফুরে রয়েছে জামায়াত।
যশোর-১ (শার্শা) আসনে বিএনপির কেন্দ্রীয় সাবেক দপ্তর সম্পাদক মফিকুল হাসান তৃপ্তি, শার্শা উপজেলা বিএনপির সভাপতি আবুল হাসান হাসান জহির, সাবেক সভাপতি খায়রুজ্জামান মধু, বর্তমান সাধারণ সম্পাদক নুরুজ্জামান লিটন দলীয় মনোনয়ন চাইছিলেন। কিন্তু এই আসনটিতে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে এক সময়ের জিয়া পরিবারের আস্থাভাজন সাবেক দপ্তর সম্পাদক মফিকুল হাসান তৃপ্তিকে। যদিও আসনটির মনোনয়ন প্রত্যাশীদের একটি পক্ষের অভিযোগ, ২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে ভাঙন ধরেছিল। দল দুটির কিছু নেতা সংস্কার প্রস্তাব তুলে শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়াকে দল দুটি থেকে বাদ দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। দুই নেত্রী সে সময় কারাবন্দি ছিলেন। ওই নেতারা সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিতি পান। তখন থেকে তৃপ্তিকেও সংস্কারপন্থী নেতা হিসাবে আখ্যা দেয় শার্শা বিএনপির একটি অংশ। এমনকি তাকে দলে জায়গা না দেয়ার দাবিতে সংবাদ সম্মেলনও করে তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক হাসান জহির। তৃপ্তি অনুসারীদের দাবি, তৃপ্তির জনপ্রিয়তায় একটি পক্ষের ষড়যন্ত্র ছিলো এটি। তৃণমূলের নেতা বলেই দল তাকে পূর্বের ন্যায় এবারও মনোনয়ন দিয়েছে। তবে তৃপ্তি মনোনয়ন পাওয়ার পর বিরোধীদের কাউকে আর দেখা যাচ্ছে না প্রচারণাতে।
যশোর-২ (ঝিকরগাছা-চৌগাছা) আসনে মনোনয়ন চেয়েছিলেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য ও ঝিকরগাছা উপজেলা বিএনপির সভাপতি সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান সাবিরা নাজমুল মুন্নী, যশোর চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি ও জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান খান, চৌগাছা উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি জহুরুল ইসলাম, জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাড. মো. ইসহক, ঝিকরগাছা উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ইমরান সামাদ নিপুণ। এমন হাফ ডজন নেতা মনোনয়ন চাইলেও বিএনপির নীতিনির্ধারকদের আস্থা রেখেছেন সাবিরা নাজমুলে। কেননা বিগত আওয়ামী লীগ সময়কালে গুমের পর হত্যা করা হয় তার স্বামী নাজমুল হোসেনকে। স্বামীর মৃত্যুর পর গৃহিনী থেকে একেবারে নতুন মুখ হিসাবে রাজনীতিতে নামেন। ২০১৪ সালের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে তিনি চেয়ারম্যান পদে জয়লাভ করেন। যদিও চেয়ারম্যান দায়িত্ব পালনকালে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা মামলায় তাকে ছয় বছর কারাদণ্ড দেন ঢাকার বিশেষ জজ আদালত। নেতাকর্মীরা বলছেন, আসনটিতে বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে একাধিক গ্রুপিং। ঝিকরগাছার একটি অংশের নেতৃত্ব দেন সাবিরা নাজমুল, অন্যটি মিজানুর রহমান খান। অন্যদিকে চৌগাছাতে একটি পক্ষ নেতৃত্ব দেন মিজানুর রহমান খান অন্যটি সাবেক উপজেলা সভাপতি জহুরুল ইসলাম। মনোনয়ন দ্বন্দ্বে জেলার সবচেয়ে বেশি গ্রপিং এই আসনটিতে। ফলে মনোনয়ন চূড়ান্ত হলেও ঐক্যে আসতে পারেননি নেতাকর্মীরা। তাই জামায়াতের হেভিওয়েট প্রার্থী ডা. মসলেম উদ্দিন অনেকটা ফুরফুরে রয়েছেন। আসনটিতে চমক দেখাতে পারেন বলে মনে করছেন নেতাকর্মীরা।
যশোর-৪ (বাঘারপাড়া-অভয়নগর ও বসুন্দিয়া ইউনিয়ন) আসনে মনোনয়ন চেয়েছিলেন কৃষক দলের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার টিএস আইয়ুব, অভয়নগর উপজেলা বিএনপির সভাপতি ফারাজী মতিয়ার রহমান ও ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ) যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক, কেন্দ্রীয় যুবদলের সাবেক সহ-আইনবিষয়ক সম্পাদক, সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার নূরে আলম সিদ্দিকী সোহাগ। দল আস্থা রেখেছে টিএস আইয়ুবের প্রতি। যদিও তার সঙ্গে মনোনয়ন দৌঁড়ে নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে দেখা যায়নি। আইয়ুব শিবিরের দাবি তিনি মনোনয়ন পাওয়ায় তৃণমূলে গণজোয়ার বইছে। তবে আইয়ুব বিরোধীরা বলছেন, টিএস আইয়ূবের ঋণখেলাপির তথ্য রয়েছে। মনোনয়ন যাচাই বাছাইকালে তার প্রার্থীতা বাতিল হওয়ার শঙ্কা রয়েছে বলে আইয়ূব বিরোধীরা আশায় বুক বাঁধছেন। যদিও শেষ পর্যন্ত বিএনপির যে নেতার প্রার্থীতাই চূড়ান্ত হোক না কেন; আসনটিতে জামায়াতের প্রার্থী জেলা আমীর অধ্যাপক গোলাম রসূল। ফলে লড়াই যে সেয়ানে সেয়ানে হবে সেটা অনুমান করছেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা।
বিএনপির এক ডজন নেতা যশোর-৫ (মণিরামপুর) আসনের প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিলেও দল এখনো কাউকে প্রার্থী ঘোষণা করেনি। বিএনপির সংশ্লিষ্ট নেতারা বলছেন, এ আসনটি শরীক দলের প্রার্থীকে ছেড়ে দেয়ার গুঞ্জন রয়েছে। যদিও স্থানীয় বিএনপির নেতারা সেই সিদ্ধান্তে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন। তারা বলছেন, শরীক নয়; স্থানীয় বিএনপির নেতাদের হাতেই উঠুক দলীয় মনোনয়ন।
যশোর-৬ (কেশবপুর) আসনে নতুন মুখ হিসেবে প্রার্থী তালিকায় রয়েছেন ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণ। তিনি বর্তমানে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য। হাফ ডজন নেতা প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিলেও মনোনয়ন বঞ্চিত হওয়ায় মাঠে নেই তারা। নেতাকর্মীরা বলছেন, শ্রাবণের দীর্ঘ রাজনৈতিক পটভূমি থাকলেও তার পরিবার আওয়ামী লীগের রাজনীতি করে। তিনি ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর তার পরিবার তাকে তাজ্য ঘোষণা করেছিল। এখনও পরিবারের সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ নেই। একই সাথে যশোর-৬ আসনে তার জনপ্রিয়তা রয়েছে।
যশোর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন খোকন বলেন, ‘ছয়টি আসনে প্রায় ৩৫ জন নেতাকর্মী দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার জন্য তৃণমূলে কাজ করেছে। সম্ভাব্য মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। মনোনয়ন নেয়ার দৌঁড়ে প্রার্থীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রতিযোগিতা ছিলো। তবে দল যাকে মনোনয়ন দিয়েছে; তার পক্ষে সবাই কাজ করবে। দ্বন্দ্ব গ্রুপিং থাকলেও আস্তে আস্তে সেটা সমাধান হবে শুধুমাত্র দলের জন্য।’
