শরণখোলা সংবাদদাতা
বঙ্গোপসাগর তটবর্তী সুন্দরবনের দুবলার চরের ঐতিহাসিক রাস উৎসব ঘিরে এবার কটোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। শুধুমাত্র সনাতন ধর্মাবলম্বী পূণ্যার্থী ছাড়া কোনো ট্যুরিস্ট যাওয়ার অনুমতি থাকবে না সেখানে।
বনের প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা, হরিণ শিকার ও প্লাস্টিক বর্জ্য দূষণরোধে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। পূণ্যার্থীদের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৫টি নৌপথ। উৎসবকে কেন্দ্র করে বনবিভাগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিরাপত্তাও বৃদ্ধি করা হয়েছে বলে জানিয়েছে বনবিভাগ।
বনবিভাগ সূত্রে জানা গেছে, আজ নভেম্বর থেকে প্রতিবছরের ন্যায় পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের দুবলার চরের আলোরকোলে অনুষ্ঠিত হবে তিন দিনের রাস উৎসব। আলোরকোলে নির্মিত অস্থায়ী মন্দিরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সনাতন ধর্মের মানুষ এসে সেখানে পূজা করবেন। সনাতন ধর্মের বিধান অনুযায়ী পূর্ণিমা ভরা তিথিতে ৫ নভেম্বর ভোরে সাগরের প্রথম জোয়ারের লোনা জলে পূণ্যস্নানের মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হবে সনাতনীদের এই মিলনমেলা।
ঐতিহাসিকভাবে জানা যায়, প্রায় ২০০ বছর আগে অর্থাৎ ১৮শ শতকের শেষভাগে বা ১৯শ শতকের শুরুর দিকে সুন্দরবনের দুবলার চরে রাস পূজা শুরু হয়। হরভজন দাস নামে এক হিন্দু সন্ন্যাসী এই রাস পূজার গোড়াপত্তন করেন। তিনি তার ভক্তদের নিয়ে রাস পূর্ণিমার তিথিতে দুবলার চরে পূজা অর্চনা ও সাগরের লোনা জলে স্নান করতেন। সেই ধর্মীয় অনুষ্ঠান থেকেই ধীরে ধীরে ‘দুবলার চরের রাস মেলা’র প্রচলন ঘটে। এর পর থেকে দুবলা ফিশারমেন গ্রুপের আয়োজনে সাগরদ্বীপ আলোরকোলে রাস পূর্ণিমা সনাতনীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় ও পর্যটন উৎসব হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
কিন্তু পরবর্তীতে এই রাস উৎসবকে কেন্দ্র করে লাখো মানুষের লোকসমাগম ঘটে। সনাতন ধর্মের মানুষের পাশাপাশি উৎসবে যোগ হয় দেশি-বিদেশি পর্যটকরাও।
ভক্ত ও পর্যটকদের ভিড়ে চাপ বাড়তে থাকে বন্যপ্রাণীর আবাসস্থলের ওপর। মেলাকে কেন্দ্র করে শব্দ দূষণ ও প্লাস্টিক বর্জ্যে ক্ষতির মুখে পড়ে বনের পরিবেশ। এছাড়া বাড়তে থাকে পূণ্যার্থীর ছদ্মবেশে আসা হরিণ শিকারী চক্রের অপতৎপরতা।
শেষমেশ জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও দূষণের কথা চিন্তা করে ২০১৭ সালে সীমিত করা হয় মেলার কার্যক্রম। এর পর থেকে রাস উৎসব শুধু ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা ও স্নান উৎসবের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়।
রাস উৎসব উদযাপন কমিটির সভাপতি ও দুবলা ফিশারমেন গ্রুপের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা কামাল উদ্দিন আহমেদ জানান, ৩ নভেম্বর থেকে রাস উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হবে। বনবিভাগের অনুমতি নিয়ে মূল পুজাস্থল আলোরকোলে শুরু হয়েছে রাধা-কৃষ্ণের অস্থায়ী মন্দির নির্মাণের কাজ। এই মন্দিরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হিন্দু ধর্মের ভক্তবৃন্দ এসে তাদের মনোবাসনা পূরণের আশায় পূজা অর্চনা করবেন। ৫ নভেম্বর প্রত্যুষে সাগরের প্রথম জোয়ারে পূণ্যস্নান শেষে পূণ্যার্থীরা যে যার গন্তব্যে ফিরে যাবেন। উৎসবকে কেন্দ্র করে যাতে কোনো ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা না ঘটে সে ব্যাপারে সতর্ক রয়েছে কমিটি।
সুন্দরবন পূর্ব বিভাগ বাগেরহাটের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা রেজাউল করিম চৌধুরী জানান, এবছর রাস উৎসবে শুধুমাত্র সনাতন ধর্মাবলম্বী পূণ্যার্থীরা যেতে পারবেন। এর বাইরে রাস উৎসবের উদ্দেশ্যে কোনো পর্যটক যেতে পারবেন না। রাস পূজায় ট্যুরিস্টদের নেয়ার জন্য কোনো ট্যুর অপারেটরকে অনুমতি দেয়া হয়নি।
তিনি আরও জানান, এর আগে রাস উৎসবে অবাধ যাতায়াতের কারণে পূণ্যার্থীদের ছদ্মবেশে হরিণ শিকারীরা প্রবেশ করতো। এছাড়াও ব্যাপক লোকসমাগমের ফলে প্লাস্টিক দূষণসহ সংরক্ষিত বনের পরিবেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল। যে কারণে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে।

