বাংলার ভোর প্রতিবেদক
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক বর্ণাঢ্য অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে ২০১৮ সালের ৪ নভেম্বর ৭২ বছর বয়সে না ফেরার দেশে চলে যান বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী তরিকুল ইসলাম। নানা ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে ঢাকার অ্যাপোলো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর প্রয়াণ শুধু বিএনপি নয়, গোটা খুলনা বিভাগ এবং বিশেষ করে যশোরের জন্য ছিল এক অপূরণীয় ক্ষতি। দলীয় নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের কাছে তিনি ‘আধুনিক যশোরের রূপকার’ হিসেবেই সমধিক পরিচিত ছিলেন।
তরিকুল ইসলামের জন্ম ১৯৪৬ সালের ১৬ নভেম্বর তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির (বর্তমান বাংলাদেশ) যশোর জেলায়। তাঁর বাবা আব্দুল আজিজ ছিলেন একজন ব্যবসায়ী এবং মা মোসাম্মৎ নূরজাহান বেগম ছিলেন গৃহিণী।
তিনি যশোর জিলা স্কুল থেকে ১৯৬১ সালে প্রবেশিকা (ম্যাট্রিক) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর সরকারি মাইকেল মধুসূদন মহাবিদ্যালয় (এমএম কলেজ) থেকে ১৯৬৩ সালে আইএ এবং ১৯৬৮ সালে অর্থনীতিতে বিএ (অনার্স) ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৯ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি অর্থনীতিতে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন।
ছাত্রজীবন থেকেই তরিকুল ইসলামের রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়। ১৯৬২ সালে যশোর এমএম কলেজের জরাজীর্ণ শহীদ মিনার নিজ উদ্যোগে সহপাঠীদের নিয়ে মেরামত করার কারণে তৎকালীন সামরিক সরকারের রোষানলে পড়ে তিনি গ্রেপ্তার হন। কারাগারে কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের সংস্পর্শে এসে তিনি বাম রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন। ১৯৬৩-৬৪ শিক্ষাবর্ষে তিনি ছাত্র ইউনিয়নের প্রার্থী হিসেবে যশোর এমএম কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনের জন্য ১৯৬৮ সালে রাজবন্দি হিসেবে যশোর ও রাজশাহীতে ৯ মাস কারাভোগ করেন এবং ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়ায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আবারও গ্রেপ্তার হন। ১৯৭০ সালে তিনি মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে (ন্যাপ) যোগ দেন এবং মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।
জিয়াউর রহমানের ডাকে বিএনপিতে যোগদান
স্বাধীনতার পর বাম রাজনীতিতে যুক্ত থাকলেও, ১৯৭৮ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ভাসানী ন্যাপ) থেকে প্রথমে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দলে (জাগদল) এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলে (বিএনপি) যোগ দেন।
তরিকুল ইসলাম ছিলেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন আহ্বায়ক কমিটির ৭৬ জন সদস্যের অন্যতম। সেই সাথে তিনি যশোর জেলা বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন আহ্বায়কেরও দায়িত্ব পান। দলীয় রাজনীতিতে তাঁর উত্থান ছিল দ্রুত এবং সুসংগঠিত। ১৯৮০ সালে তিনি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর পর্যায়ক্রমে দলের যুগ্ম মহাসচিব, ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব, ভাইস চেয়ারম্যানের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হন। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতার স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৯ সালের দলের পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিলে তিনি দলের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য পদ লাভ করেন। আপাদমস্তক রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত তরিকুল ইসলাম দলের বিভিন্ন দুর্দিনে নেতৃত্বে ও পাশে থাকার কারণে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের কাছে অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় ছিলেন।
চারবারের সংসদ সদস্য ও সফল মন্ত্রী
তরিকুল ইসলাম যশোর সদর (যশোর-৩ আসন, পূর্বে যশোর-৯) থেকে মোট চারবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি বিভিন্ন সময়ে পাঁচটি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়ার সরকারে প্রথমে সমাজকল্যাণ মন্ত্রী এবং পরে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী। ২০০১ সালের চারদলীয় জোট সরকারের সময় প্রথমে খাদ্য মন্ত্রী, তথ্যমন্ত্রী এবং পরে পরিবেশ ও বনমন্ত্রী হন।
আধুনিক যশোরের রূপকার
মন্ত্রী থাকাকালে এবং গোটা খুলনা বিভাগে বিএনপির অভিভাবক হিসেবে আমৃত্যু নেতৃত্ব দিয়ে তরিকুল ইসলাম জাতীয় রাজনীতিতে আলোচনায় ছিলেন। যশোরের উন্নয়নে তাঁর অবদান ছিল অপরিসীম। যে কারণে স্থানীয়ভাবে তিনি ’আধুনিক যশোরের রূপকার’ হিসেবে পরিচিত।
তাঁর হাত দিয়েই যশোরে অসংখ্য উন্নয়ন কাজ হয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো,
যশোর মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা। যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় অবদান। যশোর কারিগরি প্রশিক্ষণ মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা। যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতাল ও করোনারি কেয়ার ইউনিট স্থাপন। বিভাগীয় কাস্টমস অফিস স্থাপন। বেনাপোল স্থল বন্দরের উন্নয়নে ভূমিকা। যশোর মডেল পৌরসভার আধুনিকীকরণ।
তিনি যশোর থেকে প্রকাশিত ‘দৈনিক লোকসমাজ’ সংবাদপত্রের প্রকাশক এবং একসময় যশোর পৌরসভার চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
পারিবারিক জীবন ও শেষযাত্রা
তরিকুল ইসলামের স্ত্রী নার্গিস ইসলাম যশোর সরকারি সিটি কলেজে বাংলা বিভাগের উপাধ্যক্ষ পদে কর্মরত ছিলেন। তাদের দুটি ছেলে সন্তান অনিন্দ্য ইসলাম অমিত (বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক) এবং লোকসমাজ পত্রিকার সম্পাদক শান্তুনু ইসলাম সুমিত।
দীর্ঘদিন ধরে কিডনি, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগসহ বিভিন্ন জটিল স্বাস্থ্য সমস্যায় ভোগার পর ২০১৮ সালের ৪ নভেম্বর তিনি ঢাকার অ্যাপোলো হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর মৃত্যুতে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক গভীর শূন্যতার সৃষ্টি হয়।

