বাংলা ভোর প্রতিবেদক
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এমন কিছু ব্যক্তিত্ব আছেন, যাদের জীবন একই সাথে সংগ্রাম, ত্যাগ ও উন্নয়নের প্রতীক। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য, সাবেক মন্ত্রী তরিকুল ইসলাম। দলীয় গণ্ডি পেরিয়ে তিনি পরিচিতি পেয়েছিলেন ’যশোর উন্নয়নের কারিগর’ এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের রাজনীতির ‘লৌহমানব’ হিসেবে। তাঁর দীর্ঘ, বর্ণাঢ্য এবং আপসহীন রাজনৈতিক জীবন একাধারে অনুপ্রেরণার এবং শোকের। ২০১৮ সালের ৪ নভেম্বর তাঁর প্রয়াণ শুধু বিএনপি নয়, গোটা খুলনা বিভাগে এক অপূরণীয় শূন্যতা সৃষ্টি করেছে।
ছাত্র রাজনীতিতে হাতেখড়ি প্রতিবাদের আগুন
যশোরের এক সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী পরিবারে তাঁর জন্ম-১৯৪৬ সালের ১৬ নভেম্বর। কিন্তু পারিবারিক প্রাচুর্য তাঁকে আরামের জীবন দেয়নি। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি বৈষম্য ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মূর্ত প্রতীক হয়ে ওঠেন। ১৯৬২ সালে যশোর এমএম কলেজের জরাজীর্ণ শহীদ মিনার নিজ উদ্যোগে মেরামত করতে গিয়ে তৎকালীন সামরিক সরকারের রোষানলে পড়েন তিনি। এটিই ছিল তাঁর জীবনে প্রথম কারাবরণ, যা বাম রাজনীতিতে তাঁর দীক্ষার ভিত্তি স্থাপন করে।
১৯৬৩-৬৪ শিক্ষাবর্ষে তিনি ছাত্র ইউনিয়নের প্রার্থী হিসেবে এমএম কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক (জিএস) নির্বাচিত হন।
১৯৬৮ সালে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ায় তিনি নয় মাস কারাভোগ করেন। এরপর ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিতে গিয়েও তাঁকে জেলেই যেতে হয়।
ষাটের দশকের উত্তাল সময়ে বারবার কারাভোগ করা এই তরুণ নেতা প্রমাণ করেছিলেন, ক্ষমতা নয়-তাঁর রাজনীতি ছিল মানুষের জন্য। ১৯৭০ সালে তিনি মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে (ন্যাপ) যোগ দেন এবং স্বাধীনতা যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।
মাটি ও মানুষের নেতা : পৌরসভা থেকে জাতীয় মঞ্চ
স্বাধীনতার পর তাঁর রাজনীতি গ্রামের মেঠোপথ আর পৌরসভার গণ্ডিতে আবর্তিত হয়। ১৯৭৩ সালে যশোর পৌরসভার ভাইস চেয়ারম্যান এবং ১৯৭৮ সালে তিনি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন যা তাঁর স্থানীয় জনপ্রিয়তার ভিত্তি গড়ে তোলে।
১৯৭৫ সালে একদলীয় শাসনব্যবস্থা (বাকশাল)-এর কঠোর বিরোধিতা করে তিনি তিন মাস কারাভোগ করেন। এ সময় তিনি দেখিয়েছিলেন, আদর্শের প্রশ্নে তিনি কতটা আপসহীন।
১৯৭৮ সালে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আহ্বানে তিনি বিএনপিতে যোগ দেন। তিনি ছিলেন দলটির প্রতিষ্ঠাকালীন আহ্বায়ক কমিটির অন্যতম সদস্য।
তৃণমূল থেকে উঠে এসে তিনি দলের যুগ্ম মহাসচিব, ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব, ভাইস চেয়ারম্যানের মতো পদে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৯ সালে তিনি দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য হন।
জানা যায়, দলের এক দুর্দিনে তাঁকে বিএনপির মহাসচিব পদের প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ঢাকায় বাড়ি-গাড়ি না থাকার কারণ দেখিয়ে তিনি সেই পদ ফিরিয়ে দেন-যা তাঁর লোভমুক্ত এবং সাদামাটা জীবনযাত্রার এক উজ্জ্বল উদাহরণ।
মন্ত্রিত্বে সাফল্য ও যশোরের আধুনিকায়ন
যশোর সদর (যশোর-৩) থেকে চারবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া তরিকুল ইসলাম চারটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব সামলেছিলেন। তিনি ১৯৯১Ñ ৯৬ খালেদা জিয়া সরকারে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থেকে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে ভূমিকা রাখেন। ১৯৯১Ñ৯৬ খালেদা জিয়া সরকারে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে প্রথমে প্রতিমন্ত্রী ও পরে পূর্ণ মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০১-০৪ চারদলীয় জোট সরকারে তথ্য ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ে গণমাধ্যম ও খাদ্য নিরাপত্তা সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৪-০৬ চারদলীয় জোট সরকারে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ে পরিবেশ সুরক্ষায় ভূমিকা রাখেন।
তবে মন্ত্রী হিসেবে তাঁর সবচেয়ে বড় অবদান ছিল তাঁর জন্মভূমি যশোরের উন্নয়নে। তিনি বিশ্বাস করতেন, তাঁর এলাকার মানুষের জন্য রাজনীতি করা তাঁর নৈতিক দায়িত্ব।
তরিকুল ইসলামের হাতে গড়া যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, যশোর মেডিকেল কলেজ, যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতাল ও করোনারি কেয়ার ইউনিট,বেনাপোল স্থল বন্দরের আধুনিকীকরণ, যশোর কারিগরি প্রশিক্ষণ মহাবিদ্যালয় ও বিভাগীয় কাস্টমস অফিস স্থাপন। এই বিশাল কর্মযজ্ঞের কারণেই তিনি ‘আধুনিক যশোরের রূপকার’ উপাধি লাভ করেন।
একজন লৌহমানবের নীরব বিদায়
তরিকুল ইসলাম শুধু একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন সৎ ও সজ্জন দেশপ্রেমিক জননেতা। তাঁর উদারতা, সততা এবং কর্মীদের প্রতি ভালোবাসা ছিল কিংবদন্তী। তাঁর ঘনিষ্ঠজনরা বলেন, ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তিনি কখনো ব্যক্তিগত লাভের জন্য অন্যায় কাজ করেননি বা কাউকে ক্ষতিগ্রস্ত করেননি।
দীর্ঘদিন ধরে কিডনি, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস ও ক্যান্সারে ভুগছিলেন তিনি। ২০১৮ সালের ৪ নভেম্বর এই আপসহীন নেতা ঢাকার অ্যাপোলো হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর প্রয়াণ দেশ একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিককে হারায়, আর যশোর হারায় তার শ্রেষ্ঠতম কারিগরকে। তাঁর দুই সন্তান শান্তনু ইসলাম সুমিত ও অনিন্দ্য ইসলাম অমিত (বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক) এখন তাঁর আদর্শের উত্তরাধিকার বহন করছেন।

