বাংলার ভোর ডেস্ক:
রাত পোহালেই ঈদুল ফিতর। এর পরপরই বাংলা নববর্ষ পহেলা বৈশাখ। অতীতে ঈদ ও পহেলা বৈশাখ ঘিরে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা মাথায় রেখে এবার সারাদেশে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। দুটি প্রধান বড় উৎসব ঘিরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বেশিরভাগ সদস্যদের ছুটিও শিথিল করা হয়েছে। সবাই যেন নির্বিঘ্নে ও উৎসবমুখর পরিবেশে ঈদ ও বাংলা নববর্ষ উদযাপন করতে পারে সেদিকেই বিশেষ নজর দেওয়া হচ্ছে, জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
উৎসবকেন্দ্রিক ঢাকাসহ সারাদেশে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বাড়তি নিরাপত্তা নেওয়া হয়। গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতেও নজরদারি বাড়ানো হয়। এ বছরও কাছাকাছি সময়ে দুটি বৃহৎ উৎসব ঘিরে এরই মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ সদরদপ্তর থেকে জেলা পুলিশ সুপারসহ (এসপি) সব অপারেশনাল ইউনিটকে ৩৪ দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এসব নির্দেশনা বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ সতর্ক ও আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ঈদুল ফিতর ও পহেলা বৈশাখে যে কোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতি মোকাবিলায় সারাদেশ নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। পুলিশ, র্যাব, গোয়েন্দা সদস্য ছাড়াও আনসার সদস্যরা এসময় মাঠে তৎপর থাকবে। কাউকে সন্দেহভাজন মনে হলেই জিজ্ঞাসাবাদ করবে পুলিশ-র্যাবের সদস্যরা।
পুলিশ সদরদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এবার ঈদ ও পহেলা বৈশাখকেন্দ্রিক নিরাপত্তায় সর্বোচ্চ সংখ্যক পুলিশ সদস্য দায়িত্বে নিয়োজিত থাকবে। এজন্য পুলিশ সদস্যদের ছুটিও সীমিত করা হয়েছে।
র্যাব সদরদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেশের অপরাধপ্রবণ এলাকাগুলো চিহ্নিত করে রেড ও ইয়েলো জোনে ভাগ করে নিরাপত্তা পরিকল্পনা প্রস্তুত করা হয়েছে। র্যাবের অন্তত আট হাজার সদস্য এ দুই উৎসবে নিরাপত্তায় মাঠে থাকবে।
এছাড়া বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রায় ৬৫ হাজার সদস্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সহায়তায় নিয়োজিত থাকবে।
রাজধানী ঢাকাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আলাদা নিরাপত্তা ছক কষেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ থেকে বলা হয়েছে, সারাদেশে সন্দেহভাজন বা যে কোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে ৯৯৯ নম্বরে ফোনকল করে যে কেউ জরুরি সেবা নিতে পারবেন।
ঈদুল ফিতর ও পহেলা বৈশাখে যে কোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতি মোকাবিলায় সারাদেশ নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। পুলিশ, র্যাব, গোয়েন্দা সদস্য ছাড়াও আনসার সদস্যরা এসময় মাঠে তৎপর থাকবে। কাউকে সন্দেহভাজন মনে হলেই জিজ্ঞাসাবাদ করবে পুলিশ-র্যাবের সদস্যরা
পুলিশ সদরদপ্তরের দেওয়া ৩৪ নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ঈদ ও বাংলা নববর্ষসহ টানা পাঁচদিনের সরকারি ছুটিতে বিপুল সংখ্যক মানুষ রাজধানী ছেড়ে গ্রামমুখী হবেন। এ সময়ে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, অজ্ঞান ও মলম পার্টির তৎপরতা, চাঁদাবাজি ও জাল টাকার ব্যবহারের আশঙ্কা রয়েছে। সার্বিক নিরাপত্তায় সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে পুলিশ সদরদপ্তরের ডিআইজি (অপারেশনস; অতিরিক্ত আইজিপি পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, ঈদ কিংবা পহেলা বৈশাখকেন্দ্রিক কোনো ধরনের ঝুঁকি নেই। তবে সব ধরনের সতর্কতা রয়েছে। ঈদ ও পহেলা বৈশাখের বিভিন্ন অনুষ্ঠানকেন্দ্রিক নিরাপত্তার জন্য সারাদেশে পুলিশের সব ইউনিটকে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, পহেলা বৈশাখে মঙ্গল শোভাযাত্রাগুলো যেন নির্বিঘ্নে হতে পারে সে লক্ষ্যে পুলিশ কাজ করছে। ঢাকার রমনা বটমূলসহ বর্ষবরণকেন্দ্রিক অনুষ্ঠানের প্রতিটি স্থানে স্যুইপিং করা, আর্চওয়ে, মেটাল ডিটেকটর দিয়ে তল্লাশি করাসহ সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পুলিশের পাশাপাশি সাদা পোশাকে গোয়েন্দা সদস্যরাও নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবেন। এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ স্পটগুলোতে বাড়তি সতর্কতা নেওয়া হয়েছে।
ঈদ ও বর্ষবষণ ঘিরে র্যাবের পক্ষ থেকেও ছয় স্তরের নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, ঈদের আগে ঘরমুখো মানুষের নিরাপত্তায় র্যাব ঢাকাসহ সারাদেশে বিশেষভাবে কাজ করছে। ঈদের আগে ও পরে বিশেষত পহেলা বৈশাখ পর্যন্ত যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিশেষ পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
কোনো ধরনের হুমকি নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, জাতীয় ঈদগাহসহ অন্য ঈদগাহগুলোতে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ঈদের নামাজে ডগ স্কোয়াড ও বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট সার্বক্ষণিক নিয়োজিত থাকবে। যে কোনো হামলা ও নাশকতা মোকাবিলায় র্যাবের স্পেশাল ফোর্সের কমান্ডো টিম প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
কমান্ডার মঈন আরও জানান, গোয়েন্দা তথ্য ও সাইবার মনিটরিংসহ অন্য তথ্যাদি বিশ্লেষণ করে এবারের ঈদুল ফিতর বা পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে জঙ্গি হামলার ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবুও আমাদের গোয়েন্দা নজরদারি ও তৎপরতা সার্বক্ষণিক বজায় থাকবে। এছাড়া যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় র্যাবের হেলিকপ্টার প্রস্তুত থাকবে।
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার ও ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদবলেন, ঈদ ও পহেলা বৈশাখে রাজধানীতে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার ছক তৈরি করা হয়েছে। গোয়েন্দা বিভাগের পক্ষ থেকে তৈরি করা হয়েছে পৃথক নিরাপত্তা ছক। নিরাপত্তা পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের শরীর ও অন্যান্য বস্তু তল্লাশি করবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
জাতীয় ঈদগাহসহ অন্য ঈদগাহগুলোতে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ঈদের নামাজে ডগ স্কোয়াড ও বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট সার্বক্ষণিক নিয়োজিত থাকবে। যে কোনো হামলা ও নাশকতা মোকাবিলায় র্যাবের স্পেশাল ফোর্সের কমান্ডো টিম প্রস্তুত রাখা হয়েছে
তিনি বলেন, ব্যাংক ও এটিএম বুথের নিরাপত্তা আরও জোরদার করা হবে। রাতে বা দিনে একসঙ্গে মুখে মাস্ক এবং মাথায় ক্যাপ পরা অপরিচিত সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের গতিবিধি নজরদারি করা হবে।
চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের (সিএমপি) কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন জায়গায় যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, তা আমাদের দৃষ্টিতে আছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে যে ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন, আমরা সেটা নিয়েছি। আশা করি কোনো ধরনের বিপর্যয় হবে না। আর যদি কেউ বিপর্যয় ঘটাতে আসে, তাহলে আমরা সার্থকভাবে মোকাবিলা করতে পারবো।
তিনি বলেন, ঈদের পরপরই নববর্ষের অনুষ্ঠান হওয়ার কারণে খুব কম সংখ্যক পুলিশ সদস্য ছুটিতে থাকবেন। এছাড়া যারা ছুটিতে থাকবেন, তারা নববর্ষের আগেই চলে আসবেন। আর নববর্ষ ঘিরে নগরীজুড়ে তিন স্তরের নিরাপত্তা বলয় থাকবে। সাদা পোশাক, ইউনিফর্ম পরিহিত পুলিশের উপস্থিতি এবং টেকনিক্যাল সহযোগিতা নেওয়ার মাধ্যমে তিন স্তরের নিরাপত্তা গ্রহণ করা হবে।
এছাড়াও ঈদ ঘিরে বেশকিছু পদক্ষেপ নিতে নগরবাসীর প্রতি পুলিশ যে অনুরোধ জানিয়েছে, সে অনুযায়ী নাগরিকরা সহযোগিতা করলে অপ্রীতিকর কিছু ঘটার শঙ্কা নেই বলে মনে করেন কৃষ্ণপদ রায়।
ঢাকার নিরাপত্তার বিষয়ে ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান বলেন, জাতীয় ঈদগাহের জামাতসহ পুরো নগরীর সব ঈদ জামাত ঘিরে ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। জাতীয় ঈদগাহে ঈদের প্রধান জামাতে পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকবে। জাতীয় ঈদগাহ ও আশপাশের এলাকায় এসবি (স্পেশাল ব্রাঞ্চ) সদস্যরা ইক্যুইপমেন্ট ও ডিএমপির ডগ স্কোয়াড দিয়ে সুইপিং করবেন।
‘পুরো এলাকা সিসিটিভি, ড্রোন পেট্রোলিং ও ওয়াচ টাওয়ারের মাধ্যমে মনিটরিং করা হবে। পোশাকধারী পুলিশ সদস্যরা প্রবেশপথে মেটাল ডিটেক্টর, আর্চওয়ের মাধ্যমে তল্লাশি করবেন। ডিবি-এসবিসহ অন্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সাদা পোশাকে অবস্থান করবেন।
এছাড়া যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) সোয়াত টিম, ডগ স্কোয়াড ও বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট স্ট্যান্ডবাই থাকবে বলে জানান ডিএমপি কমিশনার।
নিরাপত্তার অজুহাতে বাঙালির নববর্ষবরণ তথা পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠান সংক্ষিপ্ত না করা এবং ঐতিহ্যবাহী মঙ্গল শোভাযাত্রায় পুলিশি প্রহরায় পরিবর্তন আনার আহ্বান জানিয়েছেন নববর্ষ উদযাপন কমিটির নেতারা। ডিএমপির পক্ষ থেকে সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে অনুষ্ঠান শেষ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট রাত ৯টা পর্যন্ত অনুষ্ঠান করবে বলে জানিয়েছে।
নববর্ষ উদযাপন কমিটির সংবাদ সম্মেলনে বরেণ্য শিল্পী ইমেরিটাস অধ্যাপক রফিকুন নবী বলেন, এবার দুটি আনন্দ উৎসব কাছাকাছি সময়ে উদযাপন হতে যাচ্ছে। ঢাকা থেকে অনেকেই গ্রামের বাড়িতে যাবেন। এখন ঢাকার বাইরেও সারাদেশে উৎসবের আমেজে পহেলা বৈশাখ উদযাপন হয়। এবার ঈদ-নববর্ষ একসঙ্গে। ফলে আমেজও থাকবে অন্যরকম। শিল্পী, সাহিত্যিক ও সাংবাদিকসহ সব শ্রেণিপেশার মানুষ মিলে নববর্ষের উৎসব সফল করে তুলতে ভূমিকা রাখবেন বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার বলেন, নববর্ষ উদযাপন নিয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সভাতেও বলা হয়েছে, নিরাপত্তার কথা বলে বর্ষবরণের অনুষ্ঠানের সময় সংকোচন করা ঠিক হবে না। এতে সাম্প্রদায়িক শক্তিই উৎসাহিত হবে। শঙ্কা থাকতে পারে, কিন্তু নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের।
তিনি বলেন, মঙ্গল শোভাযাত্রার নিরাপত্তা দিতে গিয়ে পুলিশ ও সশস্ত্র নিরাপত্তারক্ষীরা সামনে পেছনে ও দুই পাশে অবস্থান নিয়ে শোভাযাত্রা এমনভাবে ঘিরে রাখেন যে শোভাযাত্রার মূল সৌন্দর্যই নষ্ট হয়ে যায়। শোভাযাত্রার নান্দনিকতা রক্ষা করে নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।