বাংলার ভোর প্রতিবেদক
উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো’র আওতায় যশোরে সেকেন্ড চান্স এডুকেশন কর্মসূচি বাস্তবায়নে এনজিও ‘দিশা সমাজ কল্যাণ সংস্থা’র ‘হরিলুটের’ অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক। দুদক ইতোমধ্যে দুর্নীতি ও অনিয়মের সাথে সম্পর্কিত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ এবং অভিযোগকারীদের বক্তব্য গ্রহণ করেছে। পাশাপাশি সংস্থাটির ব্যাংক হিসাব স্থগিত করে রাখা হয়েছে।
অভিযোগকারীদের দাবি, যশোরে সেকেন্ড চান্স এডুকেশন কর্মসূচি বাস্তবায়নকারী সংস্থা ‘দিশা সমাজ কল্যাণ সংস্থা’ ৭৩ কোটি টাকার এই প্রকল্পে অন্তত ২০ কোটি টাকার অনিয়ম ও দুর্নীতি করেছে। ঝরে পড়া শিশুদের জন্য এ প্রকল্পের স্কুলগুলোর বাড়িমালিকদের সিংহভাগই ভাড়া পাননি; বেতন বকেয়া রয়েছে শিক্ষক, সুপারভাইজারদের। শিক্ষার্থীদের দেয়া হয়েছে নিম্নমানের পোশাক, ব্যাগ। নিয়োগ দেয়া হয়নি পরিচ্ছন্নতাকর্মীর, সরবরাহ করা হয়নি উপকরণ। ব্যাংকের মাধ্যমে এসব অর্থ পরিশোধের কথা থাকলেও তা করা হয়নি। বরং প্রকল্পের যাবতীয় বিল-ভাউচার তৈরি করে টাকা উত্তোলন করে নেওয়া হয়েছে। এমনকি প্রকল্পের আয়-ব্যয়ের যে ব্যাংক স্টেটমেন্ট দেয়া হয়েছে; সেটিও নিজেদের তৈরি করা। এসব বিষয় তুলে ধরে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক চেয়ারম্যান বরাবর অভিযোগ করেছেন শিক্ষক কর্মকর্তারা। অভিযোগ আমলে নিয়ে দুদকের প্রধান কার্যালয়ের নির্দেশে অভিযোগের অনুসন্ধানে নেমেছে দুদক।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গোটা দেশের ঝরেপড়া শিশু কিশোরদের শিক্ষার আওতায় আনতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তর উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো’র আওতায় ২০২০ সালে সেকেন্ড চান্স এডুকেশন (সাব-কম্পোনেন্ট ২.৫’ আউট অব স্কুল চিল্ড্রেন-(ওওএসসি) প্রোগ্রাম, পিইডিপি-৪) কর্মসূচি গ্রহণ করে। কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য প্রত্যেক জেলা থেকে একটি লিড এনজিও নির্বাচন করা হয়। যশোরে লিড এনজিও হিসেবে ‘দিশা সমাজ কল্যাণ সংস্থা’ ৬টি উপজেলা ও যশোর পৌরসভায় (দু’টি এরিয়ায় বিভক্ত করে ১ ও ২) প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব পায়। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে প্রকল্প বাস্তবায়নের শুরুতেই দিশা সমাজ কল্যাণ সংস্থা’র বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে।
অভিযোগকারীদের দাবি, কার্যক্রম শুরুর পূর্বে ঝরে পড়া শিশুর তথ্য সংগ্রহে জরিপকারীদের ৮০ ভাগ টাকা পরিশোধ করা হয়নি। গত ৩০ জুন’২৩ প্রকল্প শেষ হলেও শিক্ষক, সুপারভাইজারদের বেতন পরিশোধ করা হয়নি। ঝরে পড়া শিশুদের স্কুলের জন্য ভাড়া নেওয়া ঘরের ভাড়া পাননি সিংহভাগ বাড়ি মালিক।
সূত্র জানায়, যশোর পৌরসভাসহ ৬টি উপজেলার ৪৮১টি স্কুলকেন্দ্রের (শিখন কেন্দ্র) সিংহভাগেরই ভাড়া বকেয়া রয়েছে। এই খাতে বকেয়ার পরিমাণ দুই কোটি ১৬ লাখ টাকা। শিক্ষকদের প্রতিমাসে ৫ হাজার টাকা বেতন দেয়ার কথা থাকলেও প্রতিমাসে তারা সেই টাকা পাননি। অধিকাংশেরই অধের্কের বেশি বেতন বকেয়া। এমনকি ৫ হাজার টাকার সোশ্যাল বেনিফিটের একটি দিয়ে আরেকটি হজম করে ফেলার অভিযোগ রয়েছে। সোশ্যাল বেনিফিটের এই একটি খাতেই ২৪ লাখ টাকার অনিয়ম হয়েছে। প্রতিটি শিখন কেন্দ্রে পরিচ্ছন্নতা কর্মী নিয়োগ ও উপকরণ সরবরাহ করার কথা থাকলেও তা করা হয়নি। পরিচ্ছন্নতা কর্মীর খাতে দু’বছরে ১২ হাজার টাকা হিসেবে ৪৮১টি শিখন কেন্দ্রে অনিয়ম হয়েছে ৫৭ লাখ ৭২ হাজার টাকা। এই সব টাকাই ভুয়া বিল- ভাউচার তৈরি করে এনজিও কর্তৃপক্ষ তুলে নিয়েছেন বলে অভিযোগকারীদের দাবি।
বাঘারপাড়ার জহুরপুর ইউনিয়নের নরসিংহপুর গ্রামের কেন্দ্রের শিক্ষক জেসমিন নাহার জানান, তিনি স্কুলের ছাত্র সংগ্রহ থেকে শুরু করে দু’বছর শ্রম দিয়েছেন। বেতন পেয়েছেন মাত্র এক মাসের। স্কুলের ভাড়ার জন্য চাপ দেয়ায় তাকে বাদ নিয়ে নতুন শিক্ষক নেওয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি বকেয়া বেতন পাননি।
দুদকে অভিযোগকারীদের একজন বাঘারপাড়া উপজেলার প্রোগ্রাম সুপারভাইজার আব্দুর রহিম। তিনি জানান, শিক্ষকদের অনেক মাসের বেতন বাকী; শিখন কেন্দ্রের ভাড়া বাকী। কেন্দ্রের ভাড়া ৫শ’ টাকা দিয়ে মালিকদের শিখিয়ে দেওয়া হচ্ছে তদন্তে গেলে ১২শ’ টাকা ভাড়া পান বলে জানাতে। তাহলে পরে ওই টাকা ভাড়া দেওয়া হবে। শিক্ষকদের সোশ্যাল বেনিফিটের টাকা তুলে নেয়া হয়েছে। কোনো কেন্দ্রে কোনো পরিচ্ছন্নতা কর্মী নিয়োগ দেয়া হয়নি। তিনি নিজেও ১১ মাসের বেতন পাবেন। অথচ এসব টাকা প্রকল্প থেকে তুলে নিয়েছেন দিশার কর্মকর্তারা। ৭৩ কোটি টাকার প্রকল্পে অন্তত ৩০ কোটি টাকার অনিয়ম হয়েছে। দুদকে অভিযোগ করার পর কর্মকর্তারা তার কাছে এসে আপসের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তিনি মাথা নত করেননি। তিনি এই দুর্নীতিবাজদের শাস্তি চান।
এদিকে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, প্রধান কার্যালয়ে অভিযোগের পর দুদক সমন্বিত যশোর জেলা কার্যালয় এসব অভিযোগে অনুসন্ধান শুরু করেছে। ইতোমধ্যে সংস্থার কার্যক্রমের নথিপত্র-তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে পর্যালোচনা করছে। পাশাপাশি সংশ্লিষ্টদের সাক্ষাতকারও গ্রহণ করছে। একই সাথে দিশা’র ব্যাংক হিসাবও সাময়িক স্থগিত করা হয়েছে। ব্যাংকের নথিপত্রও পর্যালোচনা করা হচ্ছে।
যশোর উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো’র সহকারী পরিচালক হিরামন কুমার বিশ্বাস বলেন, দিশা’র বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রেক্ষিতে দুদক তদন্ত করছে। দুদক তার কাছে যেসব কাগজপত্র চেয়েছিল, তিনি তা সরবরাহ করেছেন।
অভিযোগের প্রেক্ষিতে দিশা সমাজ কল্যাণ সংস্থার নির্বাহী পরিচালক রাহিমা সুলতানা দাবি করেন, অনিয়ম দুর্নীতির সব অভিযোগ মিথ্যা।
তবে অভিযোগের প্রেক্ষিতে দুদক তদন্ত করছে। ব্যাংক হিসাব স্থগিত করার কথা স্বীকার করলেও তিনি দাবি করেন, পরে আবেদন করে হিসাব চালুর পর শিক্ষকদের বেতন দিয়েছেন।
দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক যশোর সমন্বিত কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো. আল-আমিন জানান, উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো’র আওতায় যশোরে সেকেন্ড চান্স এডুকেশন কর্মসূচি বাস্তবায়নে এনজিও ‘দিশা সমাজ কল্যাণ সংস্থা’র বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রেক্ষিতে তারা অনুসন্ধান করছেন। দায়িত্বপ্রাপ্ত তদন্ত কর্মকর্তা প্রকল্পের কাগজপত্র পর্যালোচনা, সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য ও তথ্য-উপাত্ত অনুসন্ধান করে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দেবেন। এরপর আইন অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।