কাজী নূর
‘মানুষের মধ্যেই গোঁজামিল থাকে। কিন্তু যে সাপ সে হান্ড্রেড পার্সেন্ট সাপ। যে শেয়াল সে হান্ড্রেড পার্সেন্ট শেয়াল। মানুষ সাপও হইতে পারে, শেয়ালও হইতে পারে, পাখিও হইতে পারে। মানুষেরই বিভিন্ন চরিত্র নেয়ার ক্ষমতা আছে। বুঝছো, গ্রাম দেশে আগে সাপ আর শেয়াল পাওয়া যাইতো। এগুলো নাই এখন। কারণ সাপ, শেয়াল এরা মানুষ হিসেবে জন্মাইতে আরম্ভ করছে।” ক্যামেরার কবি হিসেবে পরিচিত কিংবদন্তিতুল্য আলোকচিত্রশিল্পী নাসির আলী মামুনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ঠিক এমন কথাই বলেছিলেন বাংলাদেশের সাহিত্য ইতিহাসের অন্যতম প্রতিবাদী ও প্রগতিশীল লেখক আহমদ ছফা।
বহুমাত্রিক লেখক আহমদ ছফা একাধারে একজন কবি, সাংবাদিক, ঔপন্যাসিক, চিন্তাবিদ ও কলামিস্ট। আহমদ ছফা ১৯৪৩ সালের ৩০ জুন চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশ উপজেলার গাছবাড়িয়া গ্রামে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা হেদায়েত আলী ওরফে ধন মিয়া ছিলেন একজন কৃষক এবং মা আসিয়া খাতুন ছিলেন গৃহিণী। আহমদ ছফা অকপটে বলতেন, ‘আমার পরিবার চাষা। আমার পক্ষে এটা ওভারলুক করা কষ্টকর, রঙ চড়িয়ে কিছু বলতে চাই না। আমার পূর্বপুরুষেরা সরাসরি কৃষি উৎপাদনের সাথে যুক্ত ছিল। এই পরিচয় আমার অহংকার।’
আহমদ ছফা তার বাবার হাতে গড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দক্ষিণ গাছবাড়িয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া শুরু করেন। ১৯৬০ সালে তিনি নিত্যানন্দ গৌরচন্দ্র উচ্চবিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। ১৯৬২ সালে চট্টগ্রাম নাজিরহাট কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শেষে সে বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। যদিও সেখানে খুব বেশি দিন ক্লাস করেননি ছফা। ১৯৬৭ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজ থেকে প্রাইভেটে পরীক্ষা দিয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৭০ সালে এমএ পরীক্ষা দেওয়ার আগেই বাংলা একাডেমির পিএইচডি গবেষণা বৃত্তির জন্য আবেদন করেন এবং তিন বছরের ফেলোশিপ প্রোগ্রামের জন্য মনোনীত হন। গবেষণার বিষয় ছিল ‘১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব, বিকাশ এবং বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে তার প্রভাব’। ১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন ছফা। কর্মজীবনের প্রথম দিকে তিনি ছিলেন কলেজ শিক্ষক ও পরে পত্রিকার সম্পাদক।
আহমদ ছফার লেখা প্রবন্ধমূলক গ্রন্থগুলো সর্বাধিক আলোচিত ছিল। তার প্রবন্ধ গ্রন্থের মধ্যে ‘জাগ্রত বাংলাদেশ, বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস, বাংলা ভাষা: রাজনীতির আলোকে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক জটিলতা, বাঙালী মুসলমানের মন, রাজনীতির লেখা, নিকট ও দূরের প্রসঙ্গ, সংকটের নানা চেহারা, সাম্প্রতিক বিবেচনা: বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস, শান্তিচুক্তি ও নির্বাচিত প্রবন্ধ, বাঙালি জাতি এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্র, ইত্যাদি উল্লেখ্যযোগ্য। তার উপন্যাস ও গল্পগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে সূর্য তুমি সাথী, উদ্ধার, অলাতচক্র, ওঙ্কার, গাভীবিত্তান্ত, অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী, পুষ্পবৃক্ষ ও বিহঙ্গপুরাণ, নিহত নক্ষত্র।
কবিতার ক্ষেত্রেও সমুজ্জ্বল ছিলেন আহমদ ছফা। ‘জল্লাদ সময়’ ও ‘দুঃখের দিনের দোহা, একটি প্রবীণ বটের কাছে প্রার্থনা, লেনিন ঘুমোবে এবার, আহিতাগ্নি, তার কাব্যগ্রন্থ। অনুভূতির প্রত্যক্ষ প্রকাশ, লোকজ ভাষার ব্যবহার, পুঁথিপুরাণের শব্দ প্রয়োগ ও বাক্যরীতির সঠিক চয়নে তার কবিতাগুলো যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। আহমদ ছফার অন্যতম জনপ্রিয় একটি বই ‘যদ্যপি আমার গুরু’। এ ছাড়া তিনি ভ্রমণ কাহিনি, কিশোর গল্প ও শিশুতোষ ছড়ার বই রচনা করেছিলেন।
আহমদ ছফা স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষ বুদ্ধিজীবী বলে বিবেচিত। এই কীর্তিমান ২০০১ সালের ২৮ জুলাই অসুস্থ অবস্থায় রাজধানী ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৮০ সালে ‘ইতিহাস পরিষদ পুরস্কার’ ও ২০০২ সালে ‘মরণোত্তর একুশে পদক’ এ ভূষিত হন আহমদ ছফা।