বাংলার ভোর প্রতিবেদক
ক্ষমতায় যাওয়া আমাদের উদ্দেশ্য নয়, দেশে সুশাসন কায়েম করতে চান বলে মন্তব্য করেছেন জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান। তিনি বলেছেন, ‘আমরা যদি দেশের জন্যে কাজ করি, আপনাদের কাছে চারটি জিনিস প্রত্যাশা করি। প্রথমত একটু ভালোবাসা উপহার দেন। দ্বিতীয়ত, ভালোবাসার সঙ্গে সঙ্গে একটু সমর্থন ও সহযোগিতা চাই। তৃতীয়ত, সমর্থন ও সহযোগিতার পাশাপাশি জাতীয় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আপনাদের যেন পাশে পাই। চতুর্থত, এই জাতিকে বদলে ফেলার জন্যে আপনাদের অন্তরে যেন জায়গা পাই। এই চারটি জিনিস দেশবাসী যদি আমাদের উপহার দেয়, তাহলে আমরা চিরকাল কৃতজ্ঞ থাকবো। ক্ষমতায় যাওয়ার উদ্দেশ্য আমাদের নয়, দেশে একটা সুশাসন কায়েম করতে চাই।’
শুক্রবার বেলা ১১টার দিকে যশোর ঈদগাহে জেলা জামায়াতে ইসলামী আয়োজিত কর্মী সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
১৬ বছর পর বড় জমায়াতের মধ্যদিয়ে যশোরে কর্মী সম্মেলনের আয়োজন করল জামায়াত ইসলামী। শুক্রবার কর্মী সম্মেলন ঘিরে জামায়াত ইসলামীর নেতাকর্মীদের মাঝে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনার তৈরি হয়।
জেলা জামায়াত ইসলামীর আমীর অধ্যাপক গোলাম রসুল’র সভাপতিত্বে কর্মী সম্মেলনে প্রধান অতিথি দলের আমীর ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ‘দুঃশাসনের বিরুদ্ধে আমাদের সন্তানরা জীবন দিয়েছে। আমরা যেন তাদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি না করি, গাদ্দারি না করি। আপনারা দয়া করে কেউ চাঁদাবাজি, বাজারের দোকানপাট দখল, বালুমহাল-জলমহাল জোর করে দখল করবেন না। এই সমস্ত ঘৃণিত কাজের মাধ্যমে কোনও রিজিকের দরকার নেই।’
ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ৫ আগস্টের আগে দেশ দুঃশাসনে পরিপূর্ণ ছিল। আওয়ামী লীগ যখনই ক্ষমতায় এসেছে তখন দুঃশাসন জুলুম করেছে। বিগত সাড়ে ১৫ বছর আওয়ামী লীগের দুঃশাসন, জুলুমের কষ্ট বেশি ছিল। বাংলাদেশ, বিশ্বের মানুষ কল্পনা করতে পারেনি ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট রেজিমের পতন হবে। ফ্যাসিস্ট পতনের এই অর্জনের নেতৃত্ব আমাদের সন্তানদের। ফ্যাসিস্ট সরকার হাতুড়ি, হেলমেট বাহিনী গুড়ি চালিয়ে কোটা আন্দোলন দমাতে চেয়েছিল। আমাদের বীরসন্তানরা বিজয় ছিনিয়ে এনেছে। তাদের এই গৌরব, অভিভাবক হিসেবে আমাদেরও।
আওয়ামী লীগের সমালোচনা করে জামায়াতের আমীর ডা. শফিকুর রহমান বলেন, আমরা যাদেরকে চোর, ডাকাত হিসেবে চিনি, তাদের সক্ষমতা কতটুকু? কিন্তু কলমের খোঁচায় যারা যারা হাজার হাজার কোটি টাকা ডাকাতি করেছে, তারা বড় চোর-ডাকাত। আওয়ামী লীগ ও তার দোসরা ডাকাতি করে ব্যাংকগুলোকে ফোকলা করে দিয়েছে। ব্যাংকগুলো ব্যবসায়ীদের পুঁজি দিতে পারছে না। অন্তর্বতীকালীন সরকার অর্থনীতিকে সচল করার চেষ্টা করছে। আমরা চাই অর্থনীতি আরও গতিশীল হোক। বাজারে সিন্ডিকেট ভাঙতে পারেনি। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি রয়েছে। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার আরও উদ্যোগী হোক।
মিথ্যা মামলায় নিরীহ মানুষকে হয়রানি প্রসঙ্গে ডা. শফিকুর রহমান বলেন, মিথ্যা মামলায় নিরীহ, নিরাপরাধ মানুষকে হয়রানি বন্ধ করতে হবে। হত্যা মামলায় ৪শ-৫শ’ মানুষকে আসামি করা হচ্ছে। একজন মানুষ হত্যায় এই লোক কিভাবে জড়িত থাকে ?। প্রকৃত অপরাধীকে আসামিকে মামলা করুন। মামলার অর্থবাণিজ্য বন্ধ করতে হবে। প্রকৃত অপরাধীকে আসামি করুন, বিচার নিশ্চিত হবে।
দেশের সব মানুষের সমান অধিকার উল্লেখ করে জামায়াতে ইসলামীর আমীর বলেন, দেশে সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু বলে কিছু নেই। সবাই সাংবিধানিকভাবে সমান। ধর্ম-বর্ণ মিলেমিশে আমরা বসবাস করি। আল্লাহর কাছে জবাবহিদিতা যার যার ধর্মে করবে। কেউ যদি আপনাদের সংখ্যালঘু বলে, চিৎকার করে বলবেন, আমরা রাষ্টের নাগরিক, সবার অধিকার সমান।
তিনি আরও বলেন, এদেশে সংখ্যালঘুদের অধিকার কেড়ে নিয়েছে আওয়ামী লীগ। তারাই সবচেয়ে বেশি নির্যাতন করেছে। ২০১৩ সালে জাতিসংঘে চিঠি লিখে নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করেছিলাম। এখনও বলছি তদন্ত করুন। দোষী প্রমাণিত হলে নিজের বিচার দাবি করছি।’
দলীয় নেতাকর্মীদের উদ্দেশে জামায়াতের আমির বলেন, ‘এই সংগঠন (জামায়াতে ইসলামী) বাদ দিয়ে একটি দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়ার স্বপ্ন আর কাদের নিয়ে দেখবে। চাঁদাবাজমুক্ত দেশ, দুঃশাসনমুক্ত দেশ হবে, মানুষ আপনাদের দিকে চেয়ে আছে। সে কারণে আমাদের এগিয়ে আসতে হবে; আরও কোরবানির জন্যে তৈরি হতে হবে।’
জামায়াত ক্ষমতায় গেলে নারীদের বাড়ির বাইরে বের হতে দেবে না, এ প্রসঙ্গে জামায়াতের আমির বলেন, ‘আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা চালানো হয়। দেশে ১৮ কোটি মানুষের ধরেন ৬ কোটি ঘর আছে অথবা তিন কোটির মতো। ভাবখানা এমন, যেন আমরা তিন কোটি তালা কিনে রেখেছি। ক্ষমতায় গেলে আমরা সব ঘরে একটা করে তালা লাগিয়ে দেবো। এটি আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ।’
তিনি ওহুদের যুদ্ধের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, ‘যুদ্ধের সেই কঠিন সময়ে পুরুষরা তখন নবিজির (সা.) পাশে ছিলেন না। তখন আমাদের গর্বিত মা হজরত মুসাইবা (রা.) রাসুলের (সা.) চারপাশ ঘুরে ঘুরে তাকে নিরাপত্তা দিয়েছেন। তিনি যখন বারণ করেননি, তাহলে নারীদের ঘরবন্দি রাখার আমরা কে? বরং মায়েরা দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারেন তাদের দক্ষতা ও যোগ্যতা দিয়ে। এখন তো তাদের কোনও নিরাপত্তা নেই, মর্যাদাও দেওয়া হয় না। বিভিন্ন জায়গায় লাঞ্ছিত হচ্ছেন। কোরআনি সমাজ কায়েম হলে তারা সম্মান ও মর্যাদা ভোগ করবেন। বলতে পারবেন, আমি এ দেশের একজন গর্বিত মা।’
১৬ ডিসেম্বর ‘ভারতের বিজয় দিবস’ উল্লেখ করে মোদির দাবি প্রসঙ্গে জামায়াত আমির বলেন, বাংলাদেশের পক্ষে যখন একটা কথা ভারত উচ্চারণ করে না, তখন আপনাদের (আওয়ামী লীগ) মুখে কোনও বুলি দেখি না। আমরা প্রতিবাদ করেছি, যারা দেশকে ভালোবাসে তারা প্রতিবাদ করেছে। যার চেতনা বিক্রি করে তাদের মুখে সেদিন কোনও বুলি আমরা দেখিনি। আপনাদের এই চেতনা, এই ভালোবাসা আপনাদের কাছেই রাখেন। গত সাড়ে ৫৩ বছর আমরা দেখেছি।। এখন দেশকে সামনের দিকে নিয়ে যাওয়ার সময়, সেই সুযোগটা দেন। রাস্তা পরিষ্কার করে দেন।’
আওয়ামী লীগ শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছে, মন্তব্য করে জামায়াতের আমীর বলেন, ‘এ দেশের যুব-যুবতীরা সার্টিফিকেট নিয়ে দুয়ারে দুয়ারে ঘুরছে। কিন্তু তাঁরা চাকরি পায় না। আওয়ামী লীগ সরকার শিক্ষাব্যবস্থাকে শেষ করে দিয়েছে। শিক্ষার কোনো মান নেই। শিক্ষাব্যবস্থা দিয়েই আমরা শুরু করব। আমরা এমন শিক্ষাব্যবস্থা উপহার দিতে চাই, যেখানে প্রত্যেকে কর্মী হয়ে উঠবেন।’
যশোর জেলা উন্নয়ন বঞ্চনার চিত্র তুলে ধরে জামায়াতের আমীর ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ব্রিটিশ আমলের প্রাচীন জেলা যশোর। পুরতান জেলা হিসেবে যশোরের উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। যশোরবাসী ন্যায্য অধিকার বঞ্চিত হয়েছে। এই শহরকে কেন্দ্র করে প্রাণকেন্দ্র গড়ে তোলা দরকার। পার্ক নেই, মাঠ নেই, জলকার নেই। উন্নয়নের কথা বলে ক্ষমতায় যাওয়ার আগে মানুষের পা ছুঁয়ে নেয়, ক্ষমতায় গেলে তারা ভুলে যায়। ভাবে পাঁচ বছর পর আবার পা ছুয়ে নিলে হয়ে যাবে। মাঝখানে তারা মানুষকে মনে রাখে না।’
কর্মী সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য মোবারক হোসেন, মুহাদ্দিস আবদুল খালেক, মাওলানা আজিজুর রহমান, ঝিনাইদহ জেলা আমীর অধ্যাপক আলী আযম, সাতক্ষীরা জেলা আমীর শহিদুল ইসলাম মুকুল, মাগুরা জেলা আমীর এম বি বাকের, নড়াইল জেলা আমীর আতাউর রহমান বাচ্চু, শহিদ আবদুল্লাহর পিতা আবদুল জব্বার, যশোর জেলা নায়েবে আমীর মাওলানা হাবিবুর রহমান, যশোর পূর্ব জেলার সাবেক ভারপ্রাপ্ত আমির মাওলানা আবদুল আজিজ, ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের সহকারী সেক্রেটারি ড. আবদুল মান্নান, যশোর জেরা কর্মপরিষদ সদস্য অ্যাড. গাজী এনামুল হক, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আবদুল কাদের, অধ্যাপক মুক্তার আলী, ইসলামী ছাত্রশিবিরের শহর সভাপতি মোস্তফা কামাল, পশ্চিম সভাপতি আব্দুল্লাহ আল মামুন, জেলা ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি আশিকুজ্জামান প্রমুখ।