লালন কফি হাউজে ৩৩ বছর ধরে চলে শুধুই লালন সংগীত

প্রতীক চৌধুরী
৩৩ বছর ধরে চা ও কফি বিক্রি করেন আবদুল হামিদ (৭০)। তার দোকানের নাম রেখেছেন লালন কফি হাউজ। দোকানের নামকরণের ইতিহাস ভিন্ন। দোকানটি চালুর পর থেকে কোনদিন লালনগীতি ছাড়া অন্য কোন গান বাজান না। নামের সঙ্গে মিল রেখে তার দোকানে সারাদিন বাজে লালনগীতি। তার ক্রেতারাও লালনগীতিভক্ত। ব্যতিক্রমী এই লালন কফি হাউজ যশোরের চৌগাছা উপজেলা শহরে অবস্থিত। ব্যতিক্রমী এই দোকানে ক্রেতার ভিড় লেগেই থাকে। ব্যাকগ্রান্ড সাউন্ড হিসেবে লালনগীতি পরিবেশনে দোকানের পরিবেশও শান্ত। নেই কোন হট্টগোল। ক্রেতারা আসছেন চা, কফি পান করে চলে যান। ক্রেতারাও উপভোগ করেন সামগ্রিক পরিবেশ।
যশোরের চৌগাছা শহরের কালীতলা এলাকার বাসিন্দা আবদুল হামিদ। চৌগাছা শহরের মহেশপুর রোডের সড়কের পাশে ১৯৮২ সাল থেকে তিনি ওয়ার্কশপের কাজ করতেন। তখন থেকেই তিনি লালন সংগীত শুনতেন। তার পেশার শিষ্যরাও লালন সংগীতের প্রেমে পড়েন। ব্যবসায়িক মন্দার জেরে ১৯৯১ সালে একই জায়গায় তিনি কফি হাউজ করার সিদ্ধান্ত নেন। সবাই মিলে নাম দিলেন লালন কফি হাউজ। এ সময় দোকানে চালু করেন শুধ্ইু লালন সংগীত। সেই থেকে ৩২ বছর ধরে একটানা চলছে শুধু লালন সংগীত। লালন সংগীত পরিবেশনে টেপ রেকর্ডারের বদলে এখন সাউন্ড সিস্টেমে চলে লালন সংগীত। ৩৩ বছরে গান পরিবেশনের মাধ্যম পরিবর্তন হলেও লালন সংগীত ছাড়া, অন্য কোন গান বাজেনি তার দোকানে। তার দোকানে যারা চা, কফি পান করতে আসনে তাদের অধিকাংশই লালনভক্ত। তার এই লালন কফি হাউজ ও লালন সংগীত চালাতে না প্রতিবন্ধতা এলেও তিনি দমে যাননি। সময়ের বিবর্তনে অনেক ক্রেতা হারিয়েছেন তিনি, তবুও অবিচল রয়েছেন লালনপ্রেমে। তার এই দোকানের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে। শুধু চৌগাছা উপজেলা নয়, আশপাশের উপজেলা ও জেলার মানুষও তার দোকানে আসনে চা, কফি পান করতে। অন্য দশটি দোকানের চেয়ে ব্যতিক্রমী লালন কফি হাউজ। লালন কফি হাউজের স্বত্ত্বাধিকার আবদুল হামিদ বলেন, ফকির লালন বলেছেন ‘সত্য বল, সুপথে চল’’। তিনি তো ভাল মানুষ। মানুষকে পথ দেখিয়েছেন। লালন ফকির, তিনি তো বাউল নয়। তার তত্ত্ব ও আধ্যত্মিকতা বোঝার ক্ষমতা সবার নেই। যারা বোঝে তারা লালনকে ধারণ করেন।
তিনি বলেন, আমার দোকানের বয়স ৩৩ বছর হলেও আমি ৪৩ বছর ধরে লালন সংগীত শুনি। আমার অনেক বয়স্ক ক্রেতা ছিল। তারা অনেকেই মারা গেছেন। নতুন প্রজন্মের মধ্যেও আমি লাইন প্রেমিক খুঁজে পেয়েছি। তারাই আমার দোকানের ক্রেতা। আমার কোন উগ্রপন্থীর আনাগোনা নেই। যারা আসে সবাই সুশৃংখল। আমার কাজে সহায়তা করে ছেলে। আমার অবর্তমানে ছেলেই এই দোকানের হাল ধরবে বলে আশাবাদী।
আবদুল হামিদের বড় ছেলে রফিকুল ইসলাম বলেন, ২০০৫ সাল থেকে দোকানে বাবার সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। বাবার অবর্তমানে তিনি ব্যবসার হাল ধরতে চান। অন্য দশটি দোকানের চেয়ে ব্যতিক্রমী হওয়ায় এখানে ক্রেতা বেশি। শ্রমজীবী মানুষের পাশাপাশি চাকরিজীবীদের সমাগম বেশি।
চৌগাছা শহরের বাসিন্দা বাবু মিয়া বলেন, দশ বছর ধরে এই দোকানে এসে চা কফি খাই। কখনো লালন সংগীত ছাড়া অন্য কোন গান চালাতে শুনিনি। নামের সঙ্গে মিল রেখে দীর্ঘদিন ধরে শুধু লাইন সংগীত পরিবেশন করছেন, এটা ব্যতিক্রমী বটে। আমাদেরও খুব ভাল লাগে।
ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার মান্দারবাড়িয়া গ্রামের লিটন হোসেন বলেন, এই দোকানে কোন হইহুল্লোড় নেই, শান্ত পরিবেশ। কম সাউন্ডে সব সময় লালন সংগীত চলে। এখানকার চা, কফির মানও ভাল। এজন্য চার বছর ধরে এই দোকানে যাতায়াত করি। খুবই ভাল লাগে।
চৌগাছা উপজেলার দেবীপুর গ্রামের বাসিন্দা জুয়েল বলেন, এই দোকানে সব সময় লালনের গান পরিবেশন হয়। যারা লালন ভক্ত তাদের অধিকাংশই এই দোকানে আসেন। এছাড়াও এখানকার পরিবেশ খুবই সুন্দর। দোকানের চা ও কফির সুখ্যাতি রয়েছে। এজন্য শুধু এই উপজেলার মানুষ নয় আশপাশের জেলা-উপজেলার মানুষও আসেন।

Share.
Exit mobile version