বাংলার ভোর প্রতিবেদক
দেড় মাস আগে যশোরের চৌগাছা থানার অফিসার ইনচার্জ পদে যোগদান করেন পায়েল হোসেন। কর্মস্থলে তার বিরুদ্ধে টর্চার সেল, রিমান্ড বাণিজ্য, ঘুষবাণিজ্য, অপরাধীদের পক্ষ নিয়ে নিরীহ মানুষকে হয়রানি, নারী কেলেঙ্কারি, চাঁদাবাজি, ভয়ভীতি প্রদর্শনসহ নানা অভিযোগ পাহাড় জমা হয়। সর্বশেষ শনিবার ডিভোর্সি নারীর সাথে অশালীন অঙ্গভঙ্গিতে কথা বলা ও শরীরের গোপনাঙ্গ প্রদর্শনের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। যা নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। তার বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে পুলিশের ভাবর্মূতি ক্ষুন্ন হয়। এক পর্যায়ে রোববার তাকে চৌগাছা থানার ওসি পদ থেকে ক্লোজড করা হয়েছে। অভিযোগ তদন্তে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) রুহুল আমিনকে প্রধান করে তিন সদস্যের বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এ বিষয়ে যশোরের পুলিশ সুপার জিয়াউদ্দিন আহমেদ জানান, রোববার চৌগাছা থানার ওসি পায়েল হোসেনকে ক্লোজড করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে আসা অভিযোগ তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। আগামি পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত কমিটিকে রির্পোট জমা দিতে বলা হয়েছে। তদন্তে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
জানা গেছে, চলতি বছরের ১৭ নভেম্বর পায়েল হোসেন ঢাকার রমনা থানা থেকে বদলি হয়ে চৌগাছা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ওসি হিসেবে থানায় যোগদানের পর থেকেই বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন তিনি। সর্বশেষ ২৮ ডিসেম্বর ৫ মিনিট ১৩ সেকেন্ডের একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে। ভিডিওটিতে দেখা যায়, ওসি পায়েল কখনো অন্য একটি মোবাইলে কথা বলছেন আবার কখনো হাসতে হাসতে ওই নারীকে বিভিন্নভাবে অশালীন ইঙ্গিত দিচ্ছেন। এক পর্যায়ে নিজের পুরো শরীর প্রদর্শন করতেও দেখা যায় তাকে। এ সংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশের পর তোলপাড় সৃষ্টি হয়।
অপরদিকে, চৌগাছা বাস মালিক সমিতির সভাপতি জসিম উদ্দিনের কাছে এক কোটি টাকা দাবি করেন ওসি পায়েল হোসেন। টাকা না দেয়ায় জসিমকে বাড়িতে সারারাত অবরুদ্ধ করে রাখেন। টাকা না দেয়ায় তাকে মামলায় ফাঁসানো হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। উপজেলার ভাদড়া গ্রামের বিএনপি নেতা ব্যবসায়ী মানিক হোসেনেকে আটক করে নিজ বাংলোর একটি কক্ষে আটকে রেখে গোপনাঙ্গে ইলেক্ট্রিক শক ও শারীরিক নির্যাতন করেন। ফোন করে মানিকের স্ত্রীর তোহরা খাতুনের কাছে শুধু মার বন্ধ করতে পাঁচ লাখ টাকা দাবি করে তা আদায়ও করেন। পরে অস্ত্র মামলা ও রিমান্ড আবেদন করে তাকে আদালতে সোপর্দ করেন বলে অভিযোগ পরিবারের। মাশিলা গ্রামের পারভেজ আহমেদ সোহাগ নামে এক যুবককে তুলে এনে দুই লাখ টাকা দাবি করে ৩২ ঘণ্টা তার টর্চার সেলে আটকে রেখে ইলেক্ট্রিক শক ও শারীরিক নির্যাতন চালান এবং ফোন করে তার মাকে আহাজারি শোনান। সোহাগের মা দেড় লাখ টাকা দিতে রাজি হন। কিন্তু দুই লাখ টাকা না পেয়ে ডাকাতি, ছিনতাই ও মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের বিভিন্ন সময়ের মামলায় আসামি দেখিয়ে আদালতে সোপর্দ করে রিমান্ড আবেদন করেন বলে অভিযোগ করেন সোহাগের মা। ২৩ নভেম্বর সিংহঝুলি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হামিদ মল্লিককে গ্রেপ্তার করে ওসির টর্চার সেলে ছয় ঘণ্টা আটকে রেখে ১০ লাখ টাকা দাবি করেছিলেন ওসি পায়েল হোসেন। টাকা দিতে অস্বীকার করায় তাকে ২০১৯ সালের একটি চাঁদাবাজির মামলায় আদালতে সোপর্দ করা হয় বলে অভিযোগ করেছেন ইউপি চেয়ারম্যান আবদুল হামিদ মল্লিক।
চৌগাছা বাজারের ব্যবসায়ী জীবন হোসেন লিপু গেল ১৭ ডিসেম্বর তার বন্ধু বাবুলের ছোট ভাই হারিয়ে গেলে থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। দুইদিন পর ওসি বাবুলকে ডেকে বলেন, তাকে নরসিংদিতে পাওয়া গেছে ওখান থেকে আনতে হলে এডিশনাল এসপিকে টাকা দিতে হবে, বিভিন্ন খরচ আছে বলে দুই লক্ষ টাকা দাবি করেন । নিরুপায় হয়ে বাবুল গরু বিক্রি করে ৪০ হাজার টাকা ও তার বন্ধু জীবন হোসেন লিপুর কাছে থেকে ১০ হাজার টাকা নিয়ে মোট ৫০ হাজার টাকা ওসির হাতে তুলে দেন। পরদিন তাদের স্বজনরাই হারনো ব্যক্তিকে উদ্ধার করতে সমর্থ হলে ওসির কাছে টাকা ফেরত চান তারা। এ সময় ওসি তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করলে তারা এসপির কাছে অভিযোগ করার কথা জানান। এতে ওসি আরও রেগে যান । তারপর ‘দালাল হইতে সাবধান’ লিখে বাবুল ও জীবনের ছবি ও ফোন নং সম্বলিত পোস্টার থানার দেয়াল ও প্রাচীরে সেঁটে দেন ওসি। এরপর মুঠোফোনে জীবনকে গুলি করার হুমকিসহ নানা ধরনের ভয়ভীতি দেখাতে থাকেন। বাধ্য হয়ে জীবন এবং বাবুল প্রাণভয়ে চৌগাছা ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নেন।
এ বিষয়ে ভুক্তভোগী জীবন বলেন, ওসি আমার কাছে ২ লাখ টাকা চাঁদা চেয়েছিলেন। আমি এক লাখ টাকা দিয়েছিলাম। পরবর্তীতে তিনি আরও এক লাখ টাকার জন্য আমাকে বিশ্রী ভাষায় গালমন্দ করে হুমকি দিতে থাকেন। শুধু এই কয়টি ঘটনা সামনে এসেছে। আরও অনেক বিতর্কিত ঘটনার জন্ম দিয়েছেন পায়েল হোসেন। যেগুলো ভয়ে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করার সাহস পাননি বলে অভিযোগ আছে।
অভিযোগের বিষয়ে চৌগাছা থানার ওসি পায়েল হোসেন বলেন, ‘আমাকে ট্র্যাপে ফেলা হয়েছে। আমি ষড়যন্ত্রের শিকার।’