বাংলার ভোর প্রতিবেদক
ঝিনাইদহ-৪ (কালীগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যা মামলার তদন্তে নতুন মোড় নিয়েছে। জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক কাজী কামাল আহমেদ গিয়াস ওরফে গ্যাস বাবু গ্রেফতারের পর বদলে গেছে দৃশ্যপট। বেরিয়ে আসছে আওয়ামী লীগের একাধিক নেতার হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ততার বিষয়টি। গ্যাস বাবুর তথ্যের ভিত্তিতে গ্রেফতার করা হয়েছে ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টুকে।
তাকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে বৃহস্পতিবার আদালতে তোলা হয়। ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে আবেদন করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। আদালত ৮ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে। এমপি আনার হত্যা মামলায়, সাইদুল করিম মিন্টু গ্রেফতার ও রিমান্ডে নেয়ায় ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা।
ঝিনাইদহের ‘ফাটা কেষ্ট’ খ্যাত সাবেক পৌর মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টুকে বিভিন্ন সময়ে আলোচিত হয়েছেন কর্মকাণ্ডের কারণে। তার উত্থান নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন।
২০০৯ সালে ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু উপজেলা নির্বাচনে জামায়াত প্রার্থীর কাছে হেরেছিলেন সাইদুল করিম মিন্টু। ভোটে হারলেও ২০১১ সালে তাঁর ভাগ্যের দুয়ার খুলতে থাকে। ওই বছর ঝিনাইদহের পৌর মেয়র নির্বাচিত হন। এর পর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। সীমানা নিয়ে আইনি জটিলতায় টানা ১১ বছর মেয়র ছিলেন তিনি। এ সময় জেলার রাজনীতির শীর্ষ পদে বসার পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে তাঁর সম্পদ। এলাকায় পরিচিতি পান ‘ফাটা কেষ্ট’ হিসেবে।
ঝিনাইদহের রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একাধিক নেতার ভাষ্য, কেন্দ্রীয় বেশ কয়েক নেতার সঙ্গে ‘ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক’ থাকায় দীর্ঘদিন স্থানীয় আওয়ামী লীগে একক আধিপত্য মিন্টুর। যাকে খুশি সংগঠনে পদ দেন, আবার খেয়ালখুশিমতো বাদও দেন। সংসদ সদস্য আজীম হত্যায় অভিযুক্ত কাজী কামাল গিয়াস আহমেদ বাবুকে এভাবেই জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক পদে বসান। এখন রিমান্ডে থাকা বাবু তাঁর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে পরিচিত। ঝিনাইদহে ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগকেও কার্যত হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে আসছেন তিনি।
মিন্টু ঝিনাইদহ শহরের আরাপপুর ক্যাসল ব্রিজ-সংলগ্ন ইন্দিরা সড়কের বিলাসবহুল বাড়িতে স্ত্রী ও দুই ছেলে নিয়ে থাকেন। বর্তমানে তিনি ঝিনাইদহ চেম্বার অব কমার্স এবং দোকান মালিক সমিতির সভাপতিও।
ঝিনাইদহ আওয়ামী লীগের এক প্রবীণ নেতা বলেন, জাতীয় পার্টির সাবেক সংসদ সদস্য আশরাফুল আলমের ভাই মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে ১৯৭৩ সালে মাছ ধরতে গিয়ে জাসদ গণবাহিনীর হাতে খুন হয়েছিলেন মিন্টুর বাবা রুহুল কুদ্দুস। বাবা মারা যাওয়ার পর এলোমেলো হয়ে যায় তাঁর জীবন। পড়াশোনায় বেশি দূর এগোতে পারেননি। তাই হলফনামায় মিন্টু লেখেন ‘স্বশিক্ষিত’। পরে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যুক্ত হন। ১৯৮৩ সালে জেলা ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান। ১৯৮৪ সালে ভারমুক্ত হয়ে পূর্ণ সাধারণ সম্পাদক হন। ১৯৮৯ সালে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি হিসেবে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক নির্বাচিত হন। এর পর যুবলীগ না করে সরাসরি হয়ে যান স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা।
কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকও ছিলেন। একপর্যায়ে জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের পদ পান। ১৯৯৯-২০০০ সালে জেলার সব সহযোগী সংগঠন নিয়ে শ্রমিক লীগ গঠনে উদ্যোগী হন। এর পর ২০১৫ সালে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান সভাপতি সফিকুল ইসলাম অপু ঝিনাইদহ-২ আসন থেকে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পান। নিজের পছন্দের প্রার্থী না হওয়ায় জেলা আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে দেন মিন্টু। ২০১৪ সালেও ঝিনাইদহ-২ আসন থেকে মনোনয়ন পান অপু। অভিযোগ আছে, তাকে হারাতে নূরে আলম সিদ্দিকীর ছেলে তাহজীব আলম সিদ্দিকীকে সমর্থন দেন মিন্টু ও তার সহযোগীরা। মিন্টুর নামে বর্তমানে একাধিক মামলা রয়েছে। ১৯৯৮ সালে ছাত্রনেতা মোম হত্যাকাণ্ডের অন্যতম আসামি ছিলেন। এ ছাড়া ২০১৪ সালে শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল গফফার হত্যার ঘটনায় অন্যতম সন্দেহভাজন ছিলেন তিনি। গফফারের স্ত্রী বিভিন্ন সময় স্বামীর হত্যাকারী হিসেবে মিন্টুর নাম বলেছেন। এ ছাড়া পৌর মেয়র থাকাকালে অন্য কর্মকর্তার সঙ্গে মশক নিধন, গাড়ি মেরামত, রাস্তা পরিস্কারসহ বিভিন্ন প্রকল্পের বিলের চেকে মূল টাকার সঙ্গে অতিরিক্ত সংখ্যা বসিয়ে জালিয়াতির অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। ৩৮ চেকের মাধ্যমে প্রায় ৭৪ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে দুদকের মামলায় মিন্টুসহ চারজনকে আসামি করা হয়। ওই মামলার এখন তদন্ত চলছে।
এমপি আজীমের ভাই এনামুল হক ইমান বলেন, দুদকের ওই মামলার পেছনে আজীমের হাত ছিল বলে মনে করতেন মিন্টু। যদিও এর কোনো ভিত্তি নেই।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, পৌরসভার প্রকল্প, দোকানপাট ইজারা, বিভিন্ন সালিশ বৈঠকের নামে কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন মিন্টু। ঝিনাইদহ শহরের ক্যাসল ব্রিজ-সংলগ্ন এলাকায় তাঁর রয়েছে বিলাসবহুল বাড়ি। তার বিরুদ্ধে রয়েছে জমি দখলের অভিযোগ। এ ছাড়া শহরে জেলা বিএনপির আগের অফিসের জায়গা কিনে সেখানে গড়ে তোলেন ছয় তলা মার্কেট। পৌর এলাকার মহিষাকুণ্ডুতে রয়েছে তার বাগানবাড়ি। সদরের নারিকেলবাড়িয়া এলাকায়ও তার রয়েছে অনেক সম্পদ। এ ছাড়া দেশের বাইরেও তাঁর ব্যবসা রয়েছে বলে এলাকায় চাউর আছে। বর্তমানে মিন্টু পরিবহন, ঠিকাদারিসহ নানা ধরনের ব্যবসা করছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ নেতা জানান, কৌশলে সব সময় সংগঠনের ভেতরে ‘দ্বন্দ্ব’ তৈরি করে রাখেন তিনি। তার বিরুদ্ধে কমিটি বাণিজ্যের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আজীমের বিপক্ষেও কাজ করেছিলেন। এমপি পদে মনোনয়ন ছাড়াও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদ নিয়ে আজীমের সঙ্গে দ্বন্দ্ব ছিল মিন্টুর। সর্বশেষ সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক হতে চেয়েছিলেন আজীম, কনক কান্তি দাস এবং মিন্টু। ভোটাভুটি ছাড়াই মিন্টুকে সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা করা হয়। জেলা সম্মেলনের কয়েক মাস পর হঠাৎ কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের ১০ সদস্যের কমিটি ঘোষণা দেন মিন্টু। কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতা ছিলেন মিন্টুর অনুসারী। এ নিয়ে নেতাকর্মীর মধ্যে ক্ষোভ দেখা দেয়।