বাংলার ভোর প্রতিবেদক
মহান স্রষ্টার প্রতি সঠিক আনুগত্য, তার সন্তুষ্টি ও মানবকল্যাণে সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ করাই মূলত: ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ। এ ঈদের আনন্দ হলো ত্যাগের আনন্দ ও উৎসর্গের আনন্দ। শুধু ভোগে নয়, ত্যাগের মধ্যেও আনন্দ ও সুখ আছে। দিনটি এই শিক্ষা দেয় যে, প্রকৃত সুখ আর আনন্দের ঠিকানা সম্পদে নয়, ভোগে নয় বরং ত্যাগে। মানুষের যা কিছু আছে তা অন্যের জন্য ত্যাগের মাধ্যমেই প্রকৃত সুখ।
মুসলমানদের জন্য অফুরন্ত খুশির বার্তা নিয়ে হাজির হয় দু’টি দিন- ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। ধনী-গরিব, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব বয়সি মুসলমানদের জীবনে ঈদ হাজির করে আনন্দের বন্যা। এমনকি আমাদের দেশে অন্যান্য ধর্মের মানুষকেও ঈদের আনন্দ স্পর্শ করে। মানবিক, সাম্য, ত্যাগ ও সহমর্মিতার বিস্ময়কর ও অপরূপ আলোকপ্রভা এই ঈদের উৎসবে প্রকাশিত হয়- যা ইসলামের মাহাত্ম্য ও সর্বজনীনতার প্রতীক। আরবি ‘আওদ’ শব্দ থেকে ‘ঈদ’ শব্দের উৎপত্তি। এটি সাধারণত দুই অর্থে ব্যবহৃত হয়- ১. আনন্দ, খুশি। এ অর্থটি পবিত্র কোরআনে ব্যবহৃত হয়েছে এবং হাদিসেও এসেছ। ২. অপর অর্থ- বারবার হাজির হওয়া, ফিরে আসা প্রভৃতি।
ষষ্ঠ হিজরিতে ঈদুল আজহার প্রচলন। ঈদুল আজহা প্রতি বছর আনন্দের ও ত্যাগের পয়গম নিয়ে হাজির হয়। ঈদুল আজহাকে ঈদুল কবির অর্থাৎ মহান ঈদ বলা হয়। আজহা শব্দ জুবেহ থেকে উৎপত্তি। জবেহ করা ক্রিয়াপদ, আর আজহা অর্থাৎ জুবেহ বিশেষ্য পদ যার অর্থ কোরবানি। কোরবান বা কোরবানি শব্দের অর্থ উৎসর্গ বা ত্যাগ। এ শব্দটি কুবরের শব্দ মূল থেকে উৎপত্তি। কুবরের অর্থ নৈকট্য বা সান্নিধ্য। তাহলে ঈদুল আজহার অর্থ দাঁড়ায় কোরবানি বা উৎসর্গ বা ত্যাগের আনন্দ। আরবি আজহা শব্দের অর্থ ত্যাগ স্বীকার, কোরবানি প্রভৃতি। ঈদুল আজহায় আল্লাহর রাস্তায় ত্যাগ ও কোরবানির চেতনা ভাস্বর হয়ে ওঠে।
পশু জবেহ করার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের প্রচেষ্টা মানব ইতিহাসের জন্মলগ্ন থেকেই চলে আসছে। মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহর আদেশ পালনার্থে নিজ পুত্র হযরত ইসমাঈল (আ.)কে কোরবানি করতে প্রস্তুত হয়েছিলেন। এ ঘটনায় কোরবানির গুরুত্ব ও তাৎপর্য আরো বেড়ে যায়। এরই ধারাবাহিকতায় প্রভুপ্রেমে প্রাণ উৎসর্গ করা একটা পূণ্যময় ইবাদত বলে বিবেচিত হয়ে আসছে। কোরবানি এমন একটা মর্যাদাকর বিষয় যাতে রয়েছে একাধারে আত্মগঠন ও সুস্থ সমাজ গঠনের সর্বশ্রেষ্ঠ উপাদানাবলি। ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষের মধ্যে কোনো ধরনের পার্থক্য নেই। পার্থক্য রয়েছে শুধু আলস্নাহভীতির ক্ষেত্রে, সত্য ও অসত্যের মধ্যে, ইমানদার ও বেইমানের মধ্যে। এই দৃষ্টিকোণ থেকেই তাৎপর্য অনুমেয়। আলস্নাহর সন্তুষ্টি অর্জনের বড় মাধ্যম হিসেবে ত্যাগ স্বীকার করাই হলো কোরবানি। প্রকৃত অর্থে নিজেকে আমৃত্যু আলস্নাহর রাস্তায় সমর্পণ করা। ইসলামী শরিয়তে মুসলিম জাতির জীবনটাই একটি কোরবানিতুল্য। এ কোরবানি হতে পারে জান, মাল, সম্পদ, সময়, স্বার্থ, ইচ্ছা ও পশুর কোরবানি। আলস্নাহর সন্তুষ্টির জন্য স্বার্থত্যাগ, আত্মত্যাগ ও সম্পদত্যাগ- এটাই হলো কোরবানি। ঈদুল আজহার অর্থ নিছক পশু কোরবানি নয় বরং ত্যাগ ও উৎসর্গের অঙ্গীকার।
প্রায় পাঁচ হাজার বছর পূর্বে হযরত ইব্রাহিম (আ.) ও তার পুত্র হযরত ইসমাইল (আ.) কোরবানির নিমিত্তে অনন্য ত্যাগের আদর্শ স্থাপন করে গেছেন। দিনটি হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর ঐতিহাসিক ত্যাগের মহান স্মরণিকা। আল্লাহর নির্দেশে তিনি স্বীয় পুত্র ইসমাইলকে কোরবানি দিতে উদ্যত হয়েছিলেন
মক্কার মরু প্রান্তরে। মহান আল্লাহ হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর সংকল্পের দৃঢ়তা দেখে তার কোরবানি কবুল করেন এবং হযরত ইসমাইল (আ.) এর স্থলে একটি দুম্বা কোরবানি মঞ্জুর করেন। হযরত ইব্রাহিম (আ.)কে বহু ত্যাগ, তিতিক্ষা ও কোরবানিসহ বিভিন্ন পরীক্ষা, কণ্টকাকীর্ণ ও কঠিন রাস্তা অতিক্রম করতে হয়েছে।
প্রতিটি কালের স্তরে, কালের চাহিদা অনুযায়ী মুসলিম জাতি তার আদর্শ সামনে রেখে জাতির অস্তিত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব রক্ষার প্রয়োজনে কোরবানি দেন। কোরবানির পশু জবাই আসলে প্রতীকী ব্যাপার। আল্লাহ পাক নিজেই বলেছেন, পশুর গোশত, চামড়া, রক্ত কিছুই তার নিকট পৌঁছে না, পৌঁছে শুধু তাকওয়া ও পরহেজগারি।
ইতিহাসে পাওয়া যায়, কোরবানি দেয়ার রীতিটি পৃথিবীর আদিকাল থেকেই চলে আসছে। মানবজাতির আদি পিতা হযরত আদম (আ.)-এর সময়কালেও কোরবানির রেওয়াজ চালু ছিল। কোরবানি হযরত আদম (আ.)-এর সুন্নত ও আদর্শ। সে সময় কোরবানিকৃত মাংস/দ্রব্য পাহাড়ের চূড়ায় বা কোনো উঁচু স্থানে রেখে আসলে তা যদি আকাশ থেকে অগ্নিবর্ষিত হয়ে পুড়ে যেত তাহলে কোরবানি আলস্নাহ কবুল করেছেন বলে প্রতীয়মান হতো। যথার্থ আনুগত্য প্রদর্শন, তার সন্তুষ্টি ও মানবকল্যাণে সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ করার জন্য ধর্মীয় অঙ্গীকার ঘোষণায় সামাজিক আনন্দের উৎসব হিসেবে ঈদুল আজহা উদযাপিত হয় সারা বিশ্বে। এ উৎসব আত্মবিশ্লেষণ ও আত্মশুদ্ধিসহ পশুত্ব কোরবানির উৎসব। ঈদুল আজহা ত্যাগের আত্মসমর্পণের এবং আত্মোপলব্ধির মহান স্মারক।
হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর অনন্য ত্যাগের আদর্শ স্থাপনের ফসলই হলো কোরবানি। কোরবানি শুধুমাত্র একটি আনন্দ উৎসব নয়। এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিক্ষা ও দর্শন। ঈদুল আজহা আত্মোৎসর্গের প্রেরণায় উজ্জীবিত এক অনন্য সাধারণ আনন্দ উৎসব। কোরবানি দেয়ার ক্ষেত্রে হযরত ইব্রাহিম (আ.) সর্বশ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত এবং সর্বযুগের মানুষের জন্য অনুস্মরণীয় ও অনুকরণীয় আদর্শ স্থাপন করেছেন। শুধু পশু নয়, প্রয়োজনে পশুত্বের কোরবানি দিতে হবে। প্রতিটি মানুষের ভেতর একটি হিংস্র পশু আছে, যেটা আমাদের প্রতিনিয়ত অন্যায় ও পাপ কাজে উৎসাহিত করে থাকে এবং আত্মাকে পাপিষ্ট আত্মায় পরিণত করে। পশুত্ব হলো অপরিচ্ছন্ন শত কালিমাময় আত্মা অর্থাৎ পাপিষ্ট আত্মা। মানুষের আন্তরাত্মা পাপে ও গোনাহে ভরা, যেটার সম্মিলিত নাম পশুত্ব। সর্বপ্রথম এই পাপিষ্ট আত্মা অর্থাৎ পশুত্বকেই কোরবানি করার পর পশু কোরবানি করা উচিত। হযরত ইসমাইল (আ.)কে কোরবানি করার আগে হযরত ইব্রাহিম (আ.) নিজের জীবনকে কোরবানি করেছিলেন, সেটা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। হযরত ইব্রাহীম (আ.) এর পরিবার সারা মুসলিম উম্মাহর জন্য আদর্শ পরিবার। মুসলিম পরিবারের মধ্যে ধর্মীয়, নৈতিক মূল্যবোধ ও আদর্শবোধ স্মরণ করিয়ে দেয়। মুসলিম পরিবারের মূল্যবোধের ভিত্তি হলো আল কোরআন ও সুন্নাহ। এতে প্রতিফলিত হয়েছে হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর আদর্শের তাত্ত্ব্বিক ও বাস্তবরূপ। প্রত্যেক মুসলিম পরিবারের সদস্যদের মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ হওয়ার জন্যই হজ ও কোরবানি।
কিন্তু দুঃখের বিষয় বর্তমান বিজাতীয় অপসংস্কৃতি এবং চিন্তাধারার অনুপ্রবেশ আমাদের নৈতিক, আদর্শিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর চরম আঘাত হেনেছে। যার ফলে মুসলিম পরিবারের সদস্যরা আজ ভিন্ন ভিন্ন মেরুতে অবস্থান করায় তাদের নৈতিক আদর্শ ও মূল্যবোধ সর্বক্ষেত্রে পদদলিত। তাই হযরত ইব্রাহিম (আ.), বিবি হাজেরা এবং হযরত ইসমাইল (আ.) এর আদর্শ ও মূল্যবোধ আমাদের জীবনে প্রতিষ্ঠিত করা উচিত। ঈদুল আজহা মানুষের জীবনে নিয়ে আসে স্বতন্ত্র আদর্শের প্রতীক। মানুষের ভক্তি, বিশ্বাস ও আত্মোৎসর্গের শক্তি কত বৃহৎ রূপ নিতে পারে এই পবিত্র ঈদুল আজহার শিক্ষা, আদর্শ, তাৎপর্য ও বাস্তবতা তার প্রমাণ। যে মুসলমান ইমানের শক্তিতে শক্তিমান হয়ে নিজের পশুত্বকে কোরবানি করবে সেই কামিয়াবি এবং তার জন্য পরকালের অনন্ত জীবনে রয়েছে বেহেশত।