রেহানা ফেরদৌসী
বাংলাদেশে যেখানে একটি বড় সংখ্যার মানুষ দারিদ্র্য সীমার নীচে বসবাস করেন সেখানে এমনও কি মানুষ হয়, যিনি এতটাই প্রাণী প্রেমিক হয়, যে অনেক সময় তা যেন নিজের জীবনের চেয়েও বেশি। নিজেকে অভুক্ত রেখে, ব্যাক্তিগত সীমাবদ্ধতার মাঝে থেকেও প্রাণীদের খাবার দিচ্ছেন! এমনটা খুব কমই দেখা যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বরং উল্টোটা দেখা যায় অর্থাৎ প্রাণীদের প্রতি দয়া মায়া বা ভালবাসা দূরের কথা, পশুদের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করে থাকেন এমন মানুষের সংখ্যাই এ সমাজে বেশি। আসলে দয়া-মায়া, স্নেহ-ভালোবাসা , দুর্বল ও পীড়িত মানুষ বা প্রাণী বা পাখী এদের প্রতি মমত্ববোধ…এই সব গুণ কিছু মানুষের মধ্যে সহজাতভাবেই থাকে যা জিনগত (মবহব) বললে ভুল হবে না। তবে একথাও অনেকাংশে সত্যি যে, এই সব গুণ অর্জিত হয়, একজন মানুষ যে পরিবেশে ( বিশেষ করে নিজের পারিবারিক পরিবেশে) বড় হয়ে উঠে সেই পরিবেশ থেকে এবং সুশিক্ষায় শিক্ষিত হলে।
আজ এমনি একজন মানুষের কথা জানবো, যিনি সাধারন এর মাঝে অসাধারণ! তিনি মোহাম্মদ আব্দুল কাইয়ুম রক। তিনি একজন প্রাণী প্রেমী, প্রাণীদের উপর নির্মিত একজন জনপ্রিয় কন্টেন্ট ক্রিয়েটর। তিনি ‘রাস্তার রক্ষাকর্তা’ বা “Guardian of the street” নামক একটি সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা। এই সংগঠনের প্রধান কাজ রাস্তায় থাকা অসুস্থ ও অবহেলিত প্রাণীদের, বিশেষ করে কুকুরদের সেবায় কাজ করা। সংগঠনটি অসুস্থ প্রাণীদের চিকিৎসা, টিকাদান এবং তাদের স্বাস্থ্য-সুরক্ষায় কাজ করে থাকে। এ সংগঠনটির প্রধান উদ্দেশ্য হলো রাস্তায় থাকা অবহেলিত প্রাণীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা। আব্দুল কাইয়ুম ও তার সংগঠনটি বিভিন্ন সময়ে রাস্তার প্রাণীদের জন্য খাদ্য সহায়তা, চিকিৎসা এবং অন্যান্য সাহায্যমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন যা নিজ মাতৃভূমি ছাড়াও বহির্বিশ্বে বেশ প্রশংসিত হয়েছে। তিনি নিজ হাতে চিকিৎসাসেবা প্রদান করেছেন প্রায় সাত হাজার পাঁচশত কুকুরকে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি কার্যক্রম ঃ সেন্টমার্টিনের কুকুরদের জন্য খাদ্য সরবরাহ করা।
নিজ মাতৃভূমির অবলা প্রাণীদের প্রতি নিঃস্বার্থ ভালোবাসা ও সেবার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন মোহাম্মদ আব্দুল কাইয়ুম রক। তিনি শুধু একজন প্রাণীপ্রেমী নন, প্রাণীদের জন্য অভিভাবক সমতুল্য এক আর্শীবাদ। তার কার্যক্রম সত্যিই প্রশংসনীয় এবং মানবিকতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তার এই পথ চলা মোটেই সহজ ছিলো না।
লালমনিরহাট জেলার এক সাধারণ পরিবারে জন্ম নেয়া মোহাম্মদ আব্দুল কাইয়ুম রকের ছোটবেলা থেকেই পশুদের প্রতি ছিল গভীর ভালোবাসা। পরিবারের মা-বাবা এবং অন্যান্য সদস্যরাও ভীষণ প্রাণী প্রেমিক। শিশুকাল থেকেই তিনি রাস্তার অসহায় কুকুর-বিড়ালের প্রতি ভীষণ আকর্ষণ অনুভব করতেন। তবে তার এই অনুভূতি কেবল স্নেহের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং তিনি তাদের সমস্যা সমাধান করার জন্যে স্থায়ী কিছু করার ইচ্ছাও পোষণ করতেন। সেই ইচ্ছাই তাকে পরবর্তীতে এক নিষ্ঠাবান, ত্যাগী প্রাণী সেবকের ভূমিকায় নিয়ে আসে।
গত নয় বছরেরও বেশি সময় ধরে আব্দুল কাইয়ুম নিজেকে প্রাণী সেবায় নিয়োজিত রেখেছেন। তিনি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে, যেখানেই মুমূর্ষ বা রাস্তার আহত কুকুরদের সন্ধান পেয়েছেন, সেখানেই চিকিৎসা দেওয়া, তাদের খাদ্যের সংস্থান করা এবং বিপদে পড়া প্রাণীদের উদ্ধার করাই তার প্রতিদিনের কাজ। এখন পর্যন্ত তিনি ও তার সংগঠন প্রায় আট হাজারেরও বেশি প্রাণীদের চিকিৎসা ও পরিচর্যা প্রদান করেছেন যার মাঝে বেশিরভাগ ছিলো কুকুর। এবং প্রতিটি কার্যক্রমে তার দল, তার সাথে প্রতিনিয়ত একযোগে কাজ করে।
২০২৪ সালে পরিবেশের বিপর্যয় এবং পর্যটক স্বল্পতার কারণে সেন্টমার্টিন দ্বীপের শত শত কুকুর যখন অনাহারে মৃত্যুর পথে এগিয়ে যাচ্ছিল, তখন অনেকেই বিষয়টি উপেক্ষা করলেও আব্দুল কাইয়ুম এর মানবিক হৃদয় তা উপেক্ষা করতে পারে নি। তখন শত প্রতিবন্ধকতার (আইনি নিষেধাজ্ঞা) মধ্যেও তিনি তার দল সহ দ্বীপে ছুটে যান এবং সেখানকার অসহায় কুকুরদের খাদ্য ও চিকিৎসা সরবরাহ করেন। তার প্রচেষ্টায় বহু প্রাণী নতুন জীবন ফিরে পায়। এছাড়াও ২০২৩ সালের ভয়াবহ বন্যায় যখন অনেক প্রাণী পানিতে আটকে পড়েছিল, তখনও আব্দুল কাইয়ুম ও তার দল অক্লান্ত পরিশ্রম করে প্রাণীদের উদ্ধার ও পুনর্বাসনে কাজ করেছেন। তিনি বিভিন্ন এলাকায় খুঁজে আটকে পড়া কুকুর-বিড়ালদের উদ্ধার করেছেন এবং তৎক্ষণাৎ সেবা প্রদান করছেন। ঢাকায় পরিবারের সাথে বসবাস করলেও তার হৃদয়ের একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে এই অবলা প্রাণীগুলো। তিনি তাদের স্নেহ করেন নিজের পরিবারের সদস্যদের মতোই। তার প্রতিদিনের কার্যক্রমে একটি বিশাল অংশজুড়ে থাকে পশুদের যত্ন ও পরিচর্যা।
আব্দুল কাইয়ুম নিজেকে পশুপ্রেমী বলতে পছন্দ করেন না। কেননা রাস্তার এই অবহেলিত প্রাণীদের কাছ থেকে তিনি পেয়েছেন নিঃস্বার্থ-নির্মল ভালোবাসা। অবহেলিত এই প্রাণীরা তাকে শিখিয়েছেন…ভালোবাসা মানবধর্ম এবং তা পাওয়ার অধিকার সৃষ্টিকর্তার সকল সৃষ্টির। তারা প্রাণী এবং তিনি একজন প্রাণীপ্রেমী। তাছাড়া শুধু কুকুর-বিড়াল নয়, অবহেলিত প্রতিটি প্রাণীই তার প্রিয় এবং সকল প্রাণীদের সেবায় তিনি সর্বদা নিবেদিত।
আব্দুল কাইয়ুম শুধু ব্যক্তিগতভাবে নয়, বরং আরও বৃহৎ পরিসরে দেশের অবহেলিত ও অসহায় প্রাণীদের জন্য কাজ করতে চান। ভবিষ্যতে তিনি একটি পশু উদ্ধার ও পুনর্বাসন কেন্দ্র স্থাপনের স্বপ্ন দেখছেন, যেখানে আহত ও অসহায় প্রাণীরা আশ্রয় পাবে এবং সঠিক চিকিৎসা ও পরিচর্যার মাধ্যমে নতুন জীবন ফিরে পাবে।
মোহাম্মদ আব্দুল কাইয়ুম রক এর মতো মানুষরা সমাজে বিরল। তার এই নিরলস প্রচেষ্টা ও মানবিক কাজ আমাদের সকলের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস। তিনি প্রমাণ করেছেন যে প্রকৃত মানবতা শুধু মানুষের সেবায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং সকল প্রাণীর জন্যই ভালোবাসা ও যত্ন ছড়িয়ে দেওয়া উচিত। তার এই অবদান আমাদের সমাজে প্রাণীপ্রেম ও মানবিকতাকে আরও শক্তিশালী করে তুলবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা। পাশাপাশি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও সম্মান, মাসিক ভাতা তার প্রাপ্য।
সরকারের পাশাপাশি সিটি করপোরেশনেরও দায়িত্ব রয়েই যায়। চিকিৎসা সেবায় তার পাশাপাশি যদি সরকারি পশু হাসপাতালের চিকিৎসকগণ তার সহযোগীতায় থাকেন এবং প্রাণীদের ঔষধ প্রদানের ক্ষেত্রে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ঔষধ সরবরাহ করেন তবে তার এই কার্যক্রম আরো গতিশীল হবে, সুফল পাবে সকল প্রাণী। শুধু সরকারিভাবেই নয় বেসরকারি ভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও তাদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলে, একটু সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকতে পারবে অনেক প্রাণ।
এই পৃথিবী সৃষ্টিকর্তা শুধু মানুষের জন্য সৃষ্টি করেন নি, করেছেন তার সকল সৃষ্টি প্রতিটি প্রাণের জন্যও। এবং মানুষকে দিয়েছেন শ্রেষ্ঠত্ব। আব্দুল কাইয়ুম এর মতো এমন মানুষের জন্য শুধু তার পরিবার নয়, আমি-আপনি, আমরা সবাই গর্বিত।
তার কাজে অনুপ্রাণিত হয়ে চলুন…আমরাও হাত বাড়িয়ে দেই এ সকল অসহায় প্রাণীদের জন্য, বন্ধ করি তাদের প্রতি অমানবিকতা।
বহুদূর এগিয়ে যাক…মোহাম্মদ আব্দুল কাইয়ুম রক!
লেখক : সহ সম্পাদক, সমাজকল্যাণ বিভাগ,
পুলিশ নারী কল্যাণ সমিতি
(কেন্দ্রীয় পুনাক)

