নিজস্ব প্রতিবেদক
আসন্ন দ্বদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পাওয়া যশোর-১, যশোর-৪, যশোর-৬ আসনের প্রার্থী বর্তমান এমপি শেখ আফিল উদ্দীন, রণজিত কুমার রায়, শাহীন চাকলাদারের মনোনয়ন পত্রের সাথে জমা দেয়া হলফনামা পর্যালোচনা করে দেখা যায় তাদের সম্পদ ও অর্থের পরিমাণ বেড়েছে।
শেখ আফিল উদ্দীন
গত ৫ বছরে যশোর-১ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী সংসদ সদস্য শেখ আফিল উদ্দীনের জমি ও স্বর্ণালংকার না বাড়লেও বেড়েছে ব্যবসায়িক আয় ও সম্মানী। সেই সঙ্গে বেড়েছে মূলধন ও গাড়ি।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেয়া হলফনামার তথ্য মতে, গত ৫ বছরে তার সম্পদ বেড়েছে ১০ কোটি ৩৮ লাখ ৯৬ হাজার ৪১ টাকার। দেশের স্বনামধন্য শিল্পপতি প্রয়াত শেখ আকিজ উদ্দীনের ছেলে শেখ আফিল উদ্দীনের মোট সম্পদের পরিমাণ ৫৩ কোটি ২৯ লাখ ১৮ হাজার ১৮৫ টাকা।
একাদশ সংসদ নির্বাচনে হলফনামার তথ্য মতে শেখ আফিলের বার্ষিক আয় ছিল ৪৫ লাখ ৪৮ হাজার টাকা। গত ৫ বছরে যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ কোটি ৭৭ লাখ ১৫ হাজার ৯৪৮ টাকায়। ব্যবসা থেকে তার আয় বেড়েছে বলে হলফনামায় উল্লেখ করা হয়েছে। আগে এ আয় ছিল ২ লাখ ৯৫ হাজার ৬৫৮ টাকা, যা বর্তমানে বেড়ে ৭ কোটি ২১ লাখ ৫৭ হাজার ৫২৬ টাকা হয়েছে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সম্মানী ৯ লাখ ৯০ হাজার টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা। ব্যবসায়িক মূলধন ১৪ লাখ ৮০ হাজার ৮৬৫ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৭৩ লাখ টাকা। আগে তার ১ কোটি ৬০ লাখ ৮৪ হাজার ৪৪০ টাকা মূল্যের গাড়ি ছিল। বর্তমানে তার ৩ কোটি ২১ লাখ ৬৭ হাজার ১৮৯ টাকার মূল্যের গাড়ি রয়েছে।
একাদশ সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় শেখ আফিল উদ্দীনের নিজ নামে ৩৫৩৮.৭৫ শতক জমি ও ছয়টি বাড়ির মূল্য দেখানো হয়েছিল ১ কোটি ৬৩ লাখ ৯৪ হাজার ৫৭৭ টাকা। আর স্ত্রীর নামে ৩২৩৫ শতক জমি ও ফ্ল্যাটের মূল্য দেখানো হয়েছিল ৬১ লাখ ৭৬ হাজার ৩৭০ টাকা। এছাড়া স্বর্ণালংকার দেখানো হয়েছিল ৬০ তোলা। যার মধ্যে ১৫ তোলার মূল্য দেখানো হয় ২২ হাজার টাকা, বাকিটা উপহার। গত পাঁচ বছরে এসবের পরিমাণ অপরিবর্তিত রয়েছে।
রণজিৎ রায়
যশোর-৪ (বাঘারপাড়া-অভয়নগর উপজেলা ও বসুন্দিয়া ইউনিয়ন) আসনের বর্তমান সংসদ-সদস্য (এমপি) রণজিত কুমার রায়ের কাছে নগদ রয়েছে এক কোটি টাকা। তিনি ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনে প্রথম সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হন। টানা তিনবারের এ সংসদ সদস্যের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে। সঙ্গে বেড়েছে তার স্ত্রী নিয়তি রানীরও। নির্বাচন কমিশনে দাখিল করা ২০০৮ ও ২০২৩ সালের হলফনামার তথ্য বিশ্লেষণে এ তথ্য উঠে এসেছে।
এ বিষয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী এমপি রণজিত কুমার রায় বলেন, আমার আয়বহির্ভূত কোনো সম্পদ নেই। আয়কর ফাইলের তথ্য অনুযায়ী হলফনামায় তথ্য দিয়েছি। মানুষ হাজার কোটি টাকা নগদ রাখতে পারলে আমি কোটি টাকা রাখতে পারব না কেন?
হলফনামায় দেখা যায়, এমপি রণজিতের বর্তমান বার্ষিক আয় ৪২ লাখ ৮৫ হাজার ৭৮৩ টাকা। যা ২০০৮ সালে ছিল এক লাখ ৬৭ হাজার টাকা। তার স্ত্রীর বর্তমানে কোনো আয় নেই। আগেও ছিল না। ২০০৮ সালের হলফনামায় উল্লেখ করা হয়, রণজিত কুমার রায়ের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের মূল্য ৪ লাখ ১০ হাজার টাকা। ২০২৩ সালের হলফনামায় তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ছয় কোটি ৯৭ লাখ ৬০ হাজার ৮৬৮ টাকা। ২০০৮ সালের হলফনামায় তার স্ত্রীর নামে স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির মূল্য ছিল ৮৫ হাজার টাকা। যা বর্তমানে বেড়ে দাঁড়িয়েছে দুই কোটি ৭৩ লাখ ৭৫ হাজার ২৯৮ টাকা।
২০০৮ সালে এমপি রণজিত কুমার রায়ের নামে ২ লাখ ৬০ হাজার টাকা মূল্যের অস্থাবর সম্পদ ছিল। অস্থাবর সম্পদ বর্তমানে বেড়ে দাঁড়িয়েছে দুই কোটি ৯৭ লাখ তিন হাজার ৮৬৮ টাকা। ২০০৮ সালে স্ত্রীর নামে ৮৫ হাজার টাকা মূল্যের অস্থাবর সম্পদ ছিল। যা বর্তমানে এক কোটি ২২ লাখ তিন হাজার ২৯৮ টাকা। ২০০৮ সালে এমপি রণজিতের নামে দেড় লাখ মূল্যের স্থাবর সম্পত্তি ছিল। ১৫ বছরের ব্যবধানে তার স্থাবর সম্পদ বেড়ে দাঁড়িয়েছে চার কোটি ৫৭ হাজার টাকা। ২০০৮ সালে তার স্ত্রীর নামে কোনো স্থাবর সম্পত্তি না থাকলেও বর্তমানে এক কোটি ৫১ লাখ ৭২ হাজার টাকা মূল্যের স্থাবর সম্পদ রয়েছে।
হলফনামা বিশ্লেষণে আরও দেখা যায়, তিনি ২০০৮ সালে ৪ বিঘা কৃষিজমি পৈতৃক সূত্রে পেলেও বর্তমানে ১২ বিঘা জমির মালিক। স্ত্রীর নামে ২০০৮ সালে কোনো জমি বা বাড়ি না থাকলেও বর্তমানে ৩টি বাড়ি রয়েছে। যার মূল্য হলফনামার তথ্য অনুযায়ী এক কোটি ৪৬ লাখ ৭২ হাজার টাকা। একইসঙ্গে বাড়ি/অ্যাপার্টমেন্ট হিসাবে ৫০ লাখ টাকার উল্লেখ করেছেন। ২০০৮ সালে তার কাছে এক লাখ টাকা নগদ থাকলেও বর্তমানে এক কোটি ৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা দেখিয়েছেন। ২০০৮ সালে এমপির স্ত্রীর কাছে ৭০ হাজার টাকা নগদ ছিল। বর্তমানে ৫১ লাখ ১৬ হাজার ৮৪০ টাকা রয়েছে। আগে ব্যাংকিং সঞ্চয় ডিপিএস হিসাবে কোনো টাকা না থাকলেও বর্তমানে এমপি রণজিত রায় দম্পতির ২৭ লাখ ৩৮ হাজার ৪৯২ টাকা আছে। তার কোনো দায়দেনা নেই। হলফনামায় এমপি রণজিত তার সন্তানদের তথ্য উল্লেখ করেননি।
শাহীন চাকলাদার
যশোর-৬ কেশবপুর আসনের উপ-নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর গত তিন বছরে স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার এমপির। বেড়েছে স্বর্ণালংকারের পরিমাণও। এছাড়া শোধ করেছেন ৪ কোটি টাকার অধিক ঋণ। নির্বাচন কমিশনে তার দাখিলকৃত একাদশ ও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের হলফনামা পর্যালোচনায় এ তথ্য উঠে এসেছে। দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন তিনি। জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসক আবরাউল হাছান মজুমদার শাহীন চাকলাদারের মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই শেষে বৈধ ঘোষণা করেছেন।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যশোর-৬ আসনে নির্বাচিত হন সাবেক জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ইসমত আরা সাদেক। তার মুত্যুর কারণে আসনটি শূন্য হলে ২০২০ সালের ১৪ জুলাই উপ-নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিজয়ী হন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার। নির্বাচনের আগে তিনি যে হলফনামা দাখিল করেন তাতে তার বার্ষিক আয় দেখানো হয় ২ কোটি ৩০ লাখ ৫১ হাজার ৯৯০ টাকা। অস্থাবর সম্পত্তি হিসেবে কোন তথ্য দেয়া হয়নি। আর স্থাবর সম্পত্তি ছিলো ৯৩৮.৩৫ শতক জমি, যার মূল্য ২ কোটি ৯৪ লাখ ৫ হাজার ৬০০ টাকা। এছাড়া জাবির ইন্টারন্যাশনাল হোটেলের মালিকানার শেয়ার ১৫ লাখ টাকা, ১৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা মূল্যের ১৮.৩৫ শতক জমির উপর দুটি বাড়ি, ঢাকার মহাখালী ও কলাবাগান এলাকায় মোট ১৯ বর্গফুটের দুটি ফ্লাট, যার মূল্য ২ কোটি ৭০ লাখ ৬৯ হাজার ৯৮৫ টাকা। এছাড়া তিনি ব্যাংকে ১৪ কোটি ৫২ লাখ ৫৪ হাজার ৭৯৫ টাকার ঋণ ছিলেন।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় তার বার্ষিক আয় কমে দাঁড়িয়েছে ২ কোটি ২৮ লাখ ৫১ হাজার ৮৭৮ টাকায়। অথচ বেড়েছে তার অস্থাবর সম্পত্তি। গত তিন বছরে তিনি বন্ড, বাস-ট্রাক, ইলেক্ট্রনিক মালামাল, আসবাব, নগদ টাকা ও স্বর্ণালংকার অর্জনের মধ্য দিয়ে ৪ কোটি ৬ লাখ ১১ হাজার ৫২২ টাকার মালিক হয়েছেন। একইসাথে তার স্ত্রী একইভাবে ১ কোটি ১৯ লাখ ৩৫ হাজার টাকার মালিক হয়েছেন। হিসেবে দেখানো হয়েছে গত তিন বছরে শাহীন চাকলাদার ও তার স্ত্রী ৭৫ ভরি (২০+৫৫) স্বর্ণালংকারের মালিক হয়েছেন। যার বাজার মূল্য দেখানো হয়েছে ৪ লাখ ৪৫ হাজার টাকা।
এছাড়া স্থাবর সম্পত্তিও বেড়েছে তার। ২০২০ সালে এমপিও হওয়ার আগে জমি ছিলো ৯৩৮ দশমিক ৩৫ শতক। সেটা বর্তমানে ৩৩১ শতক বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ২৬৯ শতকে। যার মূল্য দেখানো হয়েছে ৪ কোটি ৪০ লাখ ৮৩ হাজার ৬শ’ টাকা। পাশাপাশি বাড়ির জমি ১৮.৩৫ শতক থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৮.৬১ শতকে। জমির দাম ১৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা থেকে বেড়ে ৪৮ লাখ ১৫ হাজার টাকায় দাঁড়িয়েছে। এছাড়া ১০ শতক জমি ক্রয় করতে ৪০ লাখ টাকা বায়না দিয়েছেন বলে হলফনামায় উল্লেখ করা হয়েছে।
এদিকে তার হলফনামা পর্যালোচনা করে দেখা যায় ৩ বছর আগে তিনি ঋণী ছিলেন ১৪ কোটি ৫২ লাখ ৫৪ হাজার ৭৯৫ টাকা। এমপি হওয়ার পর সেই ঋণ পরিশোধিত হয়ে এখন দাঁড়িয়েছে ১০ কোটি ৬৩ লাখ ২৯ হাজার ৯৬১ টাকায়।