বাংলার ভোর প্রতিবেদক
যশোরের দুঃখখ্যাত ভবদহ অঞ্চলের মণিরামপুর উপজেলার সুজাতপুর গ্রামের বাসিন্দা ননী বিশ্বাস। সহায় সম্বল বলতে বাড়ি আর এক বিঘা জমি। উপার্জনের জন্য সামান্য জমি টুকুই ছিল তার একমাত্র ভরসা। কিন্তু সেই জমিটাও ভবদহ গ্রাস করেছে। পানির তলেই হাবুডুবু খাচ্ছে তার স্বপ্নটুকু। পরিবারের নয় সদস্য নিয়ে এখন মানবেতর জীবন যাপন করছেন তিনি। ননী বিশ্বাস বলেন, ‘ধার ধেনা করে জমিতে আমন চাষ করেছিলাম। জলাবদ্ধতায় ধানক্ষেতে প্রচুর শেওলা জন্মেছে, যার জন্য ধানের বেশি ক্ষতি হয়েছে। যা খরচ করে চাষ করেছিলাম সেই খরচও তো উঠলো না।’ জমিতে চাষাবাদ করতে না পারায় ননী বিশ্বাসের মতন দশা ওই এলাকার হাজারো পরিবারের।
যশোরের অভয়নগর, মণিরামপুর ও কেশবপুর এবং খুলনার ডুমুরিয়া ও ফুলতলা উপজেলার অংশবিশেষ নিয়ে ভবদহ অঞ্চল। পলি পড়ে এই অঞ্চলের পানি নিস্কাশনের মাধ্যম মুক্তেশ্বরী, টেকা, শ্রী ও হরি নদী নাব্যতা হারিয়েছে। ফলে নদী দিয়ে পানি নামছে না। সবচেয়ে বেশি আঘাত হেনেছে কৃষিখাতে। পানির তলে হাবুডুবু খাচ্ছে হাজারো কৃষকের স্বপ্ন। বসত বাড়িতে পানি ওঠায় গবাদি পশু নিয়ে পড়েছেন বিপাকে। অনেকে আবার অল্প দামে তা বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। ভেসে গেছে হাজার হাজার বিঘা মাছের ঘের। লোকসানের মুখে পড়েছেন ঘের মালিকরা। কৃষিবিভাগ বলছে ক্ষতিগ্রস্থদের নানা সুযোগ-সুবিধার পাশাপাশি পরামর্শও দেওয়া হচ্ছে।
কেশবপুরের ভোগতী নরেন্দ্রপুরের কৃষক মিজানুর রহমান বলেন, তিনি একটি সমিতি থেকে ৩০ হাজার টাকা লোন নিয়ে ভবানীপুরের মাঠপাড়া বিলে পাঁচ বিঘা জমিতে আমন ধান আবাদ করেছিলেন। বন্যার পানিতে তার সব ধান নষ্ট হয়ে গেছে। এখন কীভাবে তিনি সমিতির টাকা পরিশোধ করবেন তা নিয়ে রয়েছেন দুশ্চিন্তায়। গত বছর ওই জমিতে আমন আবাদ করে প্রতি কাঠায় এক মণ করে ধান পেয়েছিলেন। এবার কোনো ধান পাওয়ার সম্ভাবনা না থাকায় তার সব স্বপ্ন বন্যার পানিতে মিশে গেছে। সুফলাকাটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এসএম মুনজুর রহমান বলেন, তার ইউনিয়নের অধিকাংশ বিলে মাছের ঘেরের ভেড়িতে আবাদ করা সবজিগাছ মরে যাওয়ায় কৃষকেরা বিপাকে পড়েছেন।
জলাবদ্ধতায় অভয়নগর উপজেলার সুন্দলী, চলিশিয়া ও পায়রা ইউনিয়নের ২৫ গ্রামের মানুষ জলাবদ্ধতার শিকার হয়ে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ভেসে গেছে শত শত মাছের ঘের। তলিয়ে গেছে অর্ধশত হেক্টর জমির সবজি ও ফসলি ক্ষেত। সুন্দলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বিকাশ রায় কপিল বলেন, সম্প্রতি অতি বর্ষণ ও নদীর পানি বৃদ্ধির কারণে আমার ইউনিয়নের বিল সংলগ্ন গ্রামগুলো জলাবদ্ধতার শিকার হয়েছে। কয়েক’শ মাছের ঘের ভেসে গেছে। প্রায় ১২৫ হেক্টর জমির সবজি ও ফসলী ক্ষেত তলিয়ে গেছে। দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ত্রাণ সহায়তা বা ক্ষতির পরিমাণ নিরুপণ করতে দেখা যায়নি। চলিশিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সানা আব্দুল মান্নান বলেন, এবারের জলাবদ্ধতায় অভয়নগর উপজেলার সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত আমার ইউনিয়ন। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, মেলেনি কোনো সরকারি সহায়তা।
প্রবীর কুমার রায়, সোহাগ বিশ্বাস, আমিনুর রহমান বাঘা, আক্তারুজ্জামান, জালাল মোল্যাসহ ক্ষতিগ্রস্থ ঘের মালিকরা বলেন, অতি বর্ষণ ও উজানের পানির কারণে তাদের হাজার হাজার বিঘা মাছের ঘের ভেসে গেছে। উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা আমিনুল হক বলেন, অভয়নগরে ৩ ইউনিয়নে ১২০ হেক্টর জমির ৩২০টি মাছের ঘের ভেসে গেছে। যার ক্ষতির পরিমান প্রায় ৫ কোটি টাকা। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা লাভলী খাতুন বলেন, রোপা-আমনের ৫৯০ হেক্টরসহ ৩৫ হেক্টর জমির সবজি ক্ষেত তলিয়ে গেছে। বিষয়টি উর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে জানানো হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী পলাশ ব্যানার্জী বলেন, হরি নদের ২ দশমিক ১ কিলোমিটার পুনর্খনন কাজ চলমান। জলাবদ্ধতা নিরসনে বৈদ্যুতিক সেচযন্ত্র দিয়ে নিরবচ্ছিন্ন পানি সরানোর কাজ চলছে। দ্রুত সমস্যা সমাধানে আরও কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হবে।