বাংলার খেলা ডেস্ক
ফিলিপাইনের রেফারির শেষ বাঁশি বাজার সঙ্গে সঙ্গে এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ২২ বছর পর ভারতকে হারাল বাংলাদেশ। সেই একই মাঠে, যেখানে ২০০৩ সালের সাফ সেমিফাইনালে মতিউর মুন্নার গোল্ডেন গোলে ভারতকে কাঁদিয়েছিল বাংলাদেশ। এরপর কেটে গেছে দুই দশক। মাঝের ১০ ম্যাচে ৬টি ড্র, ৪টি পরাজয়। ভারতের আধিপত্য যেন পাথরের মতো চেপে বসেছিল। অবশেষে জাতীয় স্টেডিয়ামেই শেষ হলো সেই অপেক্ষা। এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বের ফিরতি ম্যাচে ভারতকে ১-০ গোলে হারিয়ে বাংলাদেশ উপহার দিল আনন্দে ভরা এক রাত।

গত ২৫ মার্চ শিলংয়ে প্রথম লেগ গোলশূন্য ড্র হয়েছিল। সেদিনই বাংলাদেশের জার্সিতে অভিষেক হয় হামজা চৌধুরীর। গোলের সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশ সেদিনই জিতে ফিরতে পারত। হয়নি। কিন্তু কাল হলো। ঘরের মাঠে, গ্যালারিভরা উন্মাদনার সামনে। ম্যাচ শেষে সতীর্থরা হামজাকে কাঁধে তুলে নিলেন। কয়েকজন শুয়ে পড়লেন মাঠে। টেন্ট থেকে দৌড়ে এসে আলিঙ্গনে জড়িয়ে গেলেন বাকি সবাই। ভারতের খেলোয়াড়েরা দ্রুত মাঠ ছাড়লেন—সেটাই বলছিল সব।

২০২৭ এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বে পাঁচ ম্যাচে এটাই বাংলাদেশের প্রথম জয়। পাঁচ ম্যাচে ২ ড্র ও ১ জয়ে সংগ্রহ ৫ পয়েন্ট। গ্রুপে তৃতীয় স্থানের লড়াইয়ে এগিয়েও গেল দল। অন্যদিকে ৫ ম্যাচে ২ ড্র নিয়ে সবার নিচে ভারত। ভারতকে হারানো মানে শুধু ৩ পয়েন্ট নয়, মানসিক দিক থেকেও বড় এক জয়।

অবশ্য ভারত হারলেও তুলনায় ভালো ফুটবল খেলেছে। শুরু থেকেই তাদের লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশকে জমাট হতে না দেওয়া। সেটাই করেছে। হয়তো গোল পায়নি, কিন্তু আক্রমণে এগিয়ে ছিল তারাই। অন্যদিকে বাংলাদেশ গোল করার পর প্রায় পুরোটা সময়ই রক্ষণেই মনোযোগ দিয়েছে। ১টি গোল ছাড়া তেমন ধারালো আক্রমণ নেই, যা হয়েছে তা বিক্ষিপ্ত, পাল্টা আক্রমণে। কিন্তু এত দিনের দুর্ভাগ্য গোল করে লিড ধরে রাখতে না পারা, এ ম্যাচে কাটিয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। প্রায় ৮০ মিনিট লিড ধরে রাখা গোলটাই এনে দিয়েছে রাতের হাসি।

১১ মিনিটে পাল্টা আক্রমণে পাওয়া গোলটি সত্যিই বাঁধাই করে রাখার মতো। বাঁ দিক দিয়ে দৌড়ে উঠে রাকিব নিচু ক্রস করলেন। আর তাতেই ভারতের সর্বনাশ। গোলরক্ষক গুরপ্রীত সিং সান্ধু পোস্ট ছেড়ে বের হলেও দ্বিধায় ছিলেন। সেই সুযোগে শেখ মোরছালিন ডান পায়ে নিখুঁত প্লেসিংয়ে বল পাঠিয়ে দিলেন জালে। রাকিবের ক্যারিয়ারের সম্ভবত সেরা পাস। শুধু আক্রমণই নয়, তিনি রক্ষণেও দায়িত্ব পালন করেছেন। একবার দুর্দান্ত হেডে বিপদমুক্ত করেছেন দলকে।

২৭ মিনিটে চোট পেয়ে মাঠ ছাড়েন সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার তারিক কাজী। তাঁর জায়গায় আসেন শাকিল আহাদ। তপু, শাকিল-তাদের পাশে আরেকজন ছিলেন হামজা চৌধুরী। ৩১ মিনিটে নিশ্চিত এক গোল থেকে দলকে বাঁচালেন তিনি। বাংলাদেশের রক্ষণের ভুলে বল জমা পড়েছিল প্রতিপক্ষ লালিয়ানজুয়ালার কাছে। বক্সের ওপর থেকে মুম্বাই সিটির উইঙ্গার বলটা তুলে দেন ফাঁকা পোস্টে। গোলরক্ষক মিতুল ছিলেন না। এমন অবস্থায় হঠাৎ কোথা থেকে এসে হেডে বল ক্লিয়ার করেন হামজা। প্রেসবক্সে তখন রসিকতা-‘হামজা আর কী করবে? গোলপোস্টের নিচে দাঁড়ানোটাই বাকি!’

সেই হামজাই ৪৪ মিনিটে বক্সের বাইরে থেকে বাঁ পায়ে দুর্দান্ত ভলি নিলেন। বল অল্পের জন্য পোস্ট ছুঁয়ে বাইরে গেল। স্টেডিয়ামে তখন নিস্তব্ধতা। হামজারও যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না।

পুরো ম্যাচজুড়ে ছিল স্নায়ুচাপ। বাংলাদেশের ডিফেন্ডার তপু বর্মণ ও ভারতের মিডফিল্ডার নারাবি নিখিলের মধ্যে তর্ক ছড়িয়ে পড়ে দুই দলেই। চাপ, প্রতিপক্ষকে ছাপিয়ে ওঠার আকাঙ্ক্ষা—সব মিলিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বি দুই দলের ম্যাচটা যেন হয়ে উঠল এক দারুণ ফুটবল লড়াই।

একাদশে দুই পরিবর্তন নিয়ে নামে বাংলাদেশ। ফিরেন শমিত শোম ও চোট কাটিয়ে শেখ মোরছালিন। ১৩ নভেম্বর নেপালের বিপক্ষে ফিফা প্রীতি ম্যাচে শমিত বদলি হিসেবে নেমেছিলেন, মোরছালিন ছিলেন না দলে। তাদের জায়গা দিতে বাদ পড়েন অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়া ও জুনিয়র সোহেল রানা। ফিরেই দারুণ গোল করে আলো কেড়েছেন মোরছালিন। ৭০ মিনিটে তাকে তুলে নেন কোচ।

স্টেডিয়ামে ছিল উৎসবের আবহ। রাত ৮টার আগেই জাতীয় স্টেডিয়াম ভরে গেছে দর্শকে। বাইরে অপেক্ষায় আরও হাজারো মানুষ। গ্যালারি যেন ফেটে পড়ছে উত্তেজনায়। বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচ মানেই আবেগ, উত্তেজনার বিস্ফোরণ। তার সবটাই থাকল এ ম্যাচে। আর থাকল ২২ বছর পর ভারতকে হারাতে পারার হাসি।

বাংলাদেশ দল: মিতুল মারমা, তপু বর্মণ, তারিক কাজী, জায়ান আহমেদ (তাজ উদ্দিন), সাদ উদ্দিন, হামজা চৌধুরী, সোহেল রানা, শমিত শোম ও শেখ মোরছালিন (ইমন), রাকিব হোসেন ও ফয়সাল আহমেদ ফাহিম।

Share.
Leave A Reply Cancel Reply
Exit mobile version