ঝিনাইদহ প্রতিনিধি
মরজিনা খাতুনের (৩২) ১৪ বছর সংসারের পর স্বামী জহুরুল ইসলাম দুই ছেলেসহ তাকে ছেড়ে চলে যান। দুই ছেলেকে নিয়ে কি করবেন, কোথায় যাবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না তিনি। তখন গ্রাম থেকে চলে আসেন ঝিনাইদহ শহরে। শহরের বাসা-বাড়িতে কাজ শুরু করেন। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে কোনো রকম সংসার চলতো তার।
মরজিনার সংসারে কোনো স্বচ্ছলতা ছিল না। অভাবের কারণে দুই ছেলেকে লেখাপড়া শেখাতে পারেনি। কষ্টের মাঝেও বড় ছেলে বিয়ে করে পৃথক হয়ে যায়। মরজিনা স্বাধীনভাবে কিছু উপার্জনের চেষ্টায় ধারালো বটি কিনে উপ-শহরপাড়ার কাঁচা বাজারে বসে পড়েন মাছ কাটার কাজে।
এরপর থেকে এভাবেই চলছে তার জীবন। ৫ বছর তিনি এই পেশায় নিয়োজিত। এখন তার সংসার বেশ ভালোই চলছে। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত চলে মাছ কাঁটা ও পরিস্কারের কাজ। বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শহরের শহীদ মিনারের সামনে পিঠা বিক্রয় করেন। সবমিলিয়ে এখন মরজিনার সংসারে স্বচ্ছলতা ফিরেছে। মরজিনা ঝিনাইদহ সদর উপজেলার সাধুহাটি ইউনিয়নের বংকিরা গ্রামের আবেদ আলীর মেয়ে।
সরেজমিনে দেখা যায়, ঝিনাইদহ পৌরসভার উপ-শহরপাড়ার ওবদা কাঁচা বাজারের প্রাচীরের কোল ঘেষে সারি সারি দোকান। একপাশে বিক্রি হচ্ছে মাছ। অন্যপাশে কাঁচা সবজি। এর মাঝখানে ধরালো বটি নিয়ে বসে আছেন নারীরা। পাশে রাখা আছে ছাই আর কাঠের গুড়া। ক্রেতারা বাজার থেকে মাছ কিনে এনে তাদের কাছে দাঁড়াচ্ছেন। হাতে থাকা ব্যাগ ভর্তি মাছ তুলে দিচ্ছেন নারীদের হাতে। মাছগুলো সযত্নে কুটে পরিস্কার করে আবার ব্যাগে ভরে দিচ্ছেন। মাছ পরিস্কার করে দেয়ার বিনিময়ে তাদের দেয়া হচ্ছে পারিশ্রমিক। এমন দৃশ্য দেখা যায় ভোর ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত। এই বাজারে ৬ জন নারী ও দুই জন পুরুষ প্রতিদিন মাছ পরিস্কার করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। সংসারে ফিরেছে স্বচ্ছলতা।
উপ-শহরপাড়ার মরজিনা খাতুন বলেন, আগে বাসা বাড়িতে কাজ করতাম। সারাদিন মানুষের বাড়িতে বাড়িতে কাজ করে তেমন টাকাও পাওয়া যেত না। প্রতি মাসে যে আয় হতো তা দিয়ে দুই সন্তান নিয়ে শহরে বসবাস করা কঠিন ছিল। পরে চিন্তা করি বাসা বাড়ির কাজ বাদে অন্য কিছু করার। এজন্য একটি ধারালো বটি কিনে উপ-শহরপাড়ার কাঁচা বাজারে বসেন মাছ পরিস্কারের কাজ করতে। প্রথম কয়েকদিন তেমন কোন কাজ হতো না। প্রায় ৫ বছর ধরে মাছ পরিস্কারের কাজ করছি। এখন সংসার বেশ ভালোই চলছে।
তিনি বলেন, প্রতি কেজি ছোট মাছের জন্য ৫০ টাকা করে নেই। এছাড়া বড় মাছ কুটে ৩০ থেকে ৪০ টাকা কেজি পারিশ্রমিক নেই।
চলন্তিকা খাতুন তিনিও মাছ পরিস্কারের কাজ করেন। তার বাড়ি সদর উপজেলার নলডাঙ্গা ইউনিয়নের বাদুরগাছা গ্রামে। তার জীবনেও একই ঘটনা। ১৫ বছর আগে স্বামী তাকে তালাক দিয়ে আরেকটা বিয়ে করেছে। তিনিও আগে শহরের বাসা বাড়িতে এবং হোটেলে কাজ করতেন। দুই মেয়েকে নিয়ে সবসময় অভাবে থাকতেন তিনি। এখন এই পেশায় এসে ভালো আছেন।
চলন্তিকা জানান, সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত মাছ পরিসস্কার করে আয় হয় ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। কোনো কোনো দিন ৫০০ টাকাও আয় হয়। শুক্রবার সরকারি ছুটির দিনে মাছ কাটার চাহিদা বেশি থাকে। সরকারি কর্মকর্তারা বাজার থেকে বেশি বেশি মাছ কেনে। সেগুলো পরিস্কার করে বাড়ি নিয়ে যান। আগের পেশার থেকে এই কাজ অনেক ভালো। সকালে মাছ পরিস্কারের কাজ করি এবং বিকেলে অন্যান্য কাজ করি।
মাছ পরিস্কারের কাজে নিয়জিত আরেক নারী কবিতা। তার স্বামী হাসেম মিয়া তিনি হোটেলে মেসিয়ারের কাজ করেন। জেলার শৈলকপুর উপজেলা জন্মভিটা ছাড়া, কোনো জাগয়া-জমি নেই। এলাকায় তেমন কোনো কাজও ছিল না। তাই স্বামীর সঙ্গে শহরে আসেন তিনি। আগে স্বামীর সঙ্গে হোটেলে থালা-বাসন ধোয়ার কাজ করতেন। সারাদিন হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করার পরও তেমন বেতন দিতো না তারা। তাই কোনো উপায় না পেয়ে এই পেশা বেছে নেন কবিতা।
কবিতা বলেন, ছোট বড় সবার কাছে মাছ খুবই প্রিয়। অনেকেই ছোট বড় মাছ কিনতে চান কিন্তু বাড়িতে কাটতে ঝামেলা হয়। এ জন্য বেশিরভাগ মানুষ মাছ কিনতে চান না। এখন তারা বাজারে আমাদের দিয়ে ছোট-বড় সব মাছ কাটিয়ে নিতে পারে।
মুকুল হোসেন বলেন, আমি চাকরির সুবাদে ঝিনাইদহে ভাড়া থাকি। বাসায় কেউ এখন আর মাছ কুটতে চায় না। যে কারণে বাধ্য হয়ে বাজার থেকে মাছ পরিস্কার করে নিয়ে যাই। এতে সংসারে শান্তিও বজায় থাকে আবার সময়ও বাঁচে।
সাবেক সরকারি কর্মকর্তা এসডি শোভন বলেন, এমনিতেই সারাদিন নানা কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। বাসায় কাজের লোকের সমস্যা রয়েছে। মেয়েরা রান্নাবান্না আর ঘরের জরুরি কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। তাই সময় বাঁচাতে, বাজার থেকে মাছ কিনে পরিষ্কার করে নিয়ে যাই। এতে করে বাড়তি কোনো ঝামেলা পোহাতে হয় না।
মাছ ব্যবসায়ী জুয়েল বলেন, গত ৫ বছর হলো মহিলারা এই বাজারে মাছ কাটার কাজ করে। আমাদের কাছ থেকে মাছ কিনে মহিলাদের থেকে মাছ পরিষ্কার করে নিয়ে যায়। অনেকেই কাটার ভয়ে ছোট মাছ কিনতে চাইতো না। এখন মহিলারা মাছ কেটে দেয় যার কারণে সবাই এখন মাছ কেনে। আবার মহিলাদেরও কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে। অসহায় মহিলদের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি আমাদেরও বেচাকেনা অনেক ভালো হয়েছে।
ঝিনাইদহ পৌর কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র সাইফুল ইসলাম মধু জানান, নারীরা এখন অনেক ক্ষেত্রেই স্বাবলম্বী হচ্ছেন। মাছ কেটেও যে সংসার চালানো যায় এটা একটা নতুন আইডিয়া। নানা পেশায় এখন আধুনিকতার ছোঁয়া লাগছে। আগে স্ত্রী ও মা-চাচিরা বাড়িতে মাছ কুটতেন, এখন সেটা বাণিজ্যিকিকরণ হয়েছে। আগামীতে হয়তো মেশিনের মাধ্যমে মাছ কাটার প্রযুক্তি আবিস্কার হবে।

Share.
Leave A Reply Cancel Reply
Exit mobile version