ড. মোহাঃ হাসান আলী
ভূমিকা :
বাংলাদেশ একটি স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র, যার অভ্যুদয় হয়েছিল মানবাধিকার, গণতন্ত্র এবং জাতীয় আত্মপরিচয়ের এক অভূতপূর্ব সংমিশ্রণের মধ্য দিয়ে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ কেবল একটি ভূখন্ডের স্বাধীনতা এনে দেয়নি, বরং এটি ছিল বাঙালির জাতীয়তাবোধ, মানবিক মর্যাদা, ন্যায়বিচার এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতার জন্য পরিচালিত এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম।
এই রাষ্ট্রের মূল ভিত্তিপ্রস্তর হিসেবে সংবিধানে মানবাধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।।
কিন্তু স্বাধীনতার পাঁচ দশক পেরিয়ে এসে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট সেই আদর্শগুলোর স্থায়িত্ব ও কার্যকারিতা নিয়ে গভীর প্রশ্ন তুলেছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর অভিযোগ, রাজনৈতিক দমন-পীড়ন, গণতন্ত্রের ক্রমাগত সংকট এবং নির্বাচনী অনিশ্চয়তা-সব মিলিয়ে বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতা রাষ্ট্রের মূল চেতনাকে আবারও প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এই বিশ্লেষণে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি, জাতীয় নির্বাচনের পরিবেশ, এবং বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের আন্তঃসম্পর্ককে ফলাও করে তুলে ধরা হলো।
১. বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের দার্শনিক ভিত্তি ও রাজনৈতিক বিবর্তন
জাতীয়তাবাদ একটি জাতির সম্মিলিত চেতনা ও আত্মপরিচয়ের ভিত্তি।
বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদের ধারণা দুটি প্রধান ধারায় বিভক্ত ও বিকশিত হয়েছে:
ক) বাঙালি জাতীয়তাবাদ
খ) বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ
১. ক) বাঙালি জাতীয়তাবাদ: জন্ম ও মূলনীতি
বাঙালি জাতীয়তাবাদ ছিল মূলত ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও গণমানুষের অধিকারভিত্তিক। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন এই জাতীয়তাবাদের বীজ বপন করে এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এটিকে চূড়ান্ত রূপ দেয়।
এর মূলনীতিগুলো ছিল:
সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য: বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে একটি স্বতন্ত্র জাতিসত্তার প্রতিষ্ঠা।
বৈষম্যবিরোধী সংগ্রাম: তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ।
গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচার: সকল নাগরিকের জন্য সমান অধিকার, রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা।
এই জাতীয়তাবাদ ছিল অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং এর ভিত্তি ছিল মানবিক মর্যাদা ও অধিকারের প্রশ্ন।
১. খ) বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ: সম্প্রসারণ ও রাজনৈতিক বিভাজন
স্বাধীনতার পর, বিশেষত ১৯৭০-এর দশকের শেষার্ধে, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ মতাদর্শটি সামনে আসে। এর প্রধান লক্ষ্য ছিল:
♦ রাষ্ট্রভিত্তিক পরিচয়: কেবল ভাষাগত পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে বসবাসকারী সকল নাগরিকের সমন্বযয়ে একটি রাষ্ট্রীয় পরিচয় প্রতিষ্ঠা করা?।
♦ ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় উপাদান: এই জাতীয়তাবাদে বাঙালি সংস্কৃতির পাশাপাশি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক বাস্তবতাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়, যা একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিচয়বাদ হিসেবে বিবেচিত হয়।
♦ সার্বভৌমত্বের সুরক্ষা: দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে অক্ষুণ্ণ রাখার ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করা।
তবে, জাতীয়তাবাদের দুটি ধারণা প্রচলিত থাকায় বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ধারণা দুর্বল হাতিয়ারে পরিণত হয়। ক্ষমতা অর্জন ও রক্ষার জন্য বাংগালী জাতীয়তাবাদের ব্যবহার বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের মূল লক্ষ্য জাতীয় ঐক্যকে দুর্বল করেছে এবং মানবিক চেতনাকে গৌণ করে তুলেছে। সত্যিকারের বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ মানে হবে-দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা এবং একই সঙ্গে প্রতিটি নাগরিকের মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক অধিকারকে সম্মান করা।
১ বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয় অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বাংলাদেশে মানবাধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
২ বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ মূলত বাংলাদেশের সীমানার মধ্যে বসবাসকারী বাংলাদেশীদের আত্মিক বন্ধনের ওপরে ভিত্তি করে গড়ে ওঠে।
৩ বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ আসলে অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিচয়বাদ।
২. মানবাধিকারের বর্তমান প্রেক্ষাপট: গভীর সংকট ও আন্তর্জাতিক উদ্বেগ
মানবাধিকার হলো মানুষের জন্মগত ও অবিচ্ছেদ্য অধিকার, যা রাষ্ট্র বা সরকার কর্তৃক সুরক্ষিত হওয়ার কথা। কিন্তু বাংলাদেশে গত এক দশকে মানবাধিকার পরিস্থিতি চরম উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে।
এই সংকটকে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলো:

৩. আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরিবেশ ও গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ
একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন গণতন্ত্রের প্রাণ। কিন্তু বাংলাদেশে নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে গভীর অস্থিরতা ও অবিশ্বাস বিরাজ করছে।
নির্বাচনী ব্যবস্থার বিতর্ক : বিগতদিনে বিরোধী দলগুলোর প্রধান দাবি ছিল একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা, যা ততকালীন সরকার সংবিধানের দোহাই দিয়ে প্রত্যাখ্যান করেছে। এই অনড় অবস্থান রাজনৈতিক সংলাপের পথ বন্ধ করে দিয়েছিলো।
আস্থার সংকট: নির্বাচন কমিশন (EG) এবং প্রশাসনের পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ আস্থাহীনতা আরও বাড়িয়েছে। রাজনৈতিক সহিংসতা, বিরোধী দলের সভা-সমাবেশে বাধা এবং নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে গভীর অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছিলো। যার রেশ এখনো রেয়ে গেছে। নির্বাচন কমিশন (EG) এবং প্রশাসনের উপর মানুষের আস্থা এখনো সংকটে।
ভোটারদের ভয় ও হতাশা : সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা না থাকায় ভোটারদের মধ্যে এক ধরনের ভয় ও হতাশা কাজ করেছে। যা এখনো পুরোপুরি কাটিয়ে উঠা সম্ভব হয়নি। এ কারনেই বলা হচ্ছে মানবাধিকার রক্ষিত না হলে ভোটের অধিকারও অর্থহীন হয়ে পড়বে।
৪. জাতীয়তাবাদ, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের আন্তঃসম্পর্ক
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মূল দর্শন ছিল গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও সামাজিক ন্যায়বিচার। এই তিনটি ধারণা একে অপরের পরিপূরক এবং একটিকে বাদ দিয়ে অন্য দুটির অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না।
“মানবাধিকার রক্ষিত না হলে গণতন্ত্র টিকে না, আর গণতন্ত্র না থাকলে মানবাধিকারও নিশ্চিহ্ন হযে যায।”
৪ গণমাধ্যম এবং স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদন অনুসারে, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের ঘটনা উদ্বেগজনক।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এক প্রতিবেদনে বলেছে, প্রতিপক্ষকে দমনে নির্বিচারে গ্রেপ্তার ও অন্যায়ভাবে আটক করা হয়েছে এবং হচ্ছে।
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংকট : কন্ঠরোধ, স্বাধীনতা হরণ, সর্বত্র ভয়ের ছায়া।
জাতীয়তাবাদ ও মানবাধিকার : একটি সত্যিকারের বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ কেবল ভূখণ্ড ও সার্বভৌমত্বের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি দেশের প্রতিটি নাগরিকের মানবিক মর্যাদা ও অধিকার নিশ্চিত করার অঙ্গীকার। যখন রাষ্ট্র তার নাগরিকদের মৌলিক অধিকার (যেমন: জীবনের অধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার) লঙ্ঘন করে, তখন জাতীয়তাবাদের মূল ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে।
গণতন্ত্র ও মানবাধিকার : গণতন্ত্র হলো এমন একটি শাসন ব্যবস্থা যেখানে জনগণ তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করে এবং তাদের অধিকার সুরক্ষিত হয়। মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্র অনুযায়ী, ভোটের অধিকার এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা হলো মৌলিক মানবাধিকার। যখন নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয় এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করা হয়, তখন গণতন্ত্র কেবল একটি আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয় এবং মানবাধিকারের লঙ্ঘন আরও সহজ হয়ে ওঠে।
৫. আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা ও কূটনৈতিক চাপবাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ও নির্বাচনী প্রক্রিয়া আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক আলোচিত।
.আন্তর্জাতিক আহ্বান: জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো নিয়মিতভাবে বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের আহ্বান জানিয়ে আসছে। তারা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপের মাধ্যমে সংকট সমাধানের ওপর জোর দিয়েছে।
কূটনৈতিক পদক্ষেপ: যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি একটি গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক চাপ হিসেবে কাজ করেছে। এই নীতিতে বলা হয়েছে যারা নির্বাচন প্রক্রিইয়া ব্যাহত করবে, তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হতে পারে।
সরকারের অবস্থান: সরকার এই আন্তর্জাতিক চাপকে প্রায়শই দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখেছে এবং তাদের অবস্থানে অনড় থেকেছে এবং এখনো থাকছে।
৬. ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা ও করণীয়
বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় আদর্শকে পুনরুদ্ধার এবং একটি স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো জরুরি :
উপসংহার
বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় চেতনা গড়ে উঠেছিল স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের পবিত্র আদর্শে। বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় সেই মূল্যবোধগুলোর বিকৃতি জাতীয় চেতনায় গভীর সংকট সৃষ্টি করেছে। একটি সত্যিকারের বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ কেবল ভূখণ্ডের স্বাধীনতা নয়, বরং দেশের প্রতিটি নাগরিকের মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক অধিকারের নিশ্চয়তা দেয়। জাতীয়তাবাদ, মানবাধিকার ও গণতন্ত্র এই তিনটি স্তম্ভ একে অপরের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত। একটিকে উপেক্ষা করলে বাকি দু’টি টিকবে না। এই আদর্শগুলোর পুনরুদ্ধারই পারে বাংলাদেশকে তার জন্মলগ্নের অঙ্গীকারের পথে ফিরিয়ে আনতে।
লেখক : মানবাধীকার কর্মী ও যুগ্ম-আহবায়ক, বাঙ্গালাদেশ জাতীয়তাবাদী মানবাধীকার সংস্থা, কেন্দ্রীয় কাউন্সিল।

