♦ হত্যা মিশনে ৫ কোটি টাকা দেয় বাঘববোয়ালরা
♦ মিন্টুকে উপনির্বাচনে এমপি করার টোপ
বাংলার ভোর ডেস্ক
ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যাকাণ্ডের তদন্তে নতুন মোড় নেওয়ার পর নানা অজানা তথ্য বেরিয়ে আসছে। জিজ্ঞাসাবাদে ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টু যশোর ও ঝিনাইদহের পাশাপাশি ঢাকার কয়েকজন ব্যক্তির নামও বলেছেন। তাদের মধ্যে আছেন রাজনৈতিক নেতা, সাবেক সংসদ সদস্য ও ব্যবসায়ী।
যাদের নাম এসেছে তাদের কললিস্ট পরীক্ষা করা হচ্ছে। ওই সব রাঘববোয়াল আনারকে হত্যা করার জন্য ৫ কোটি টাকা দিলেও খরচ হয়েছে মাত্র অর্ধকোটি টাকা। বাকি সাড়ে ৪ কোটি টাকা মেরে দিয়েছেন আরেক মাস্টারমাইন্ড আখতারুজ্জামান শাহীন।
অর্থ দেয়ার পাশাপাশি মিন্টুকে ঝিনাইদহে উপনির্বাচনে সংসদ সদস্য (এমপি) করার টোপ দিয়ে রেখেছিলেন রাঘববোয়ালরা। মিন্টুকে আটকের পর দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদে ভেঙে পড়ে তথ্য দিতে থাকেন তদন্তকারী কর্মকর্তাদের কাছে। তার কাছ থেকেই জানা যাচ্ছে রাঘববোয়ালদের নাম।
এর আগে ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক কাজী কামাল আহম্মেদ ওরফে গ্যাস বাবুকে গ্রেপ্তারের পর আনার হত্যাকাণ্ডে রাজনীতি-সংশ্লিষ্টতার তথ্য পায় তদন্তকারীরা। সেই সূত্রে গ্রেপ্তার করা হয় সরকারি দলের ঝিনাইদহ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টুকে।
আনার হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তারকৃত সাইদুল করিম মিন্টুকে আট দিনের রিমান্ডে নিয়েছে তদন্তকারী সংস্থা। এর আগে মঙ্গলবার বিকেল থেকে বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত তাকে গোয়েন্দা কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। প্রথমে মুখ না খুললেও তথ্য-প্রমাণ হাজির করে জিজ্ঞাসাবাদ শুরুর একপর্যায়ে সবকিছু স্বীকার করে গোয়েন্দাদের আদ্যোপান্ত জানান মিন্টু। তাছাড়া রিমান্ডে থাকা গ্যাস বাবুও মিন্টুর জড়িত থাকার বিষয়ে তথ্য দেন। এরপর মিন্টুকে আনারের মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়।
মূলত ঝিনাইদহ-৪ আসনের এমপির হওয়ার লোভে পড়ে নেপথ্যে থাকার একটি বড় শক্তির ইন্ধনে মিন্টু এ খুনে জড়িয়ে পড়েন বলে পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) এক কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন। ওই কর্মকর্তা বলেছেন, মিন্টুর হয়ে কাজ করেন রিমান্ডে থাকা জেলার আরেক নেতা গ্যাস বাবু। হত্যাকাণ্ড বাস্তবায়নে ছিলেন কোটচাঁদপুরের আখতারুজ্জামান শাহীন ও চরমপন্থি নেতা আমানুল্লাহ ওরফে শিমুল ভূঁইয়া এবং তার সঙ্গীরা।
হত্যার পেছনে সোনা চোরাচালান ও হুন্ডি কারবার :
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ডিবির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, হত্যার মূল কারণ সোনা চোরাচালান ও হুন্ডি ব্যবসা।
গত কয়েক বছর ঢাকার কয়েকজন কথিত শীর্ষ ব্যবসায়ী ও ঝিনাইদহ জেলার দুই প্রান্তে অবস্থিত দুটি জেলার সাবেক এমপি এবং একই এলাকার প্রভাবশালী নেতাদের সঙ্গে চোরাচালানের টাকার ভাগবাটোয়ারার দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন আনার। সম্প্রতি তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব চরম পর্যায়ে পৌঁছে।
সেজন্য তারা আনারকে সরিয়ে দেয়ার পথ খুঁজছিলেন। একপর্যায়ে এই সিন্ডিকেটের নজরে পড়ে আনারের সঙ্গে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মিন্টুর দ্বন্দ্বের বিষয়টি।
তারা মিন্টুকে আনারের আসনে এমপি বানানোর লোভ দেখান। মিন্টুও তাদের ফাঁদে পা দিয়ে বসেন। এ নিয়ে দফায় দফায় তাদের সঙ্গে মিন্টুর বৈঠক হয়। একপর্যায়ে খুনের দায়িত্ব নেন মিন্টু। মূলত চোরাচালানের দ্বন্দ্ব হলেও খুনে ব্যবহৃত হয়েছে রাজনৈতিক শত্রুতা।
শাহীন ও মিন্টুর সঙ্গে ঢাকায় বৈঠক :
পুলিশ সূত্র জানায়, আনারকে খুনের দায়িত্ব নেয়ার পর কোটচাঁদপুরের শাহীনের সঙ্গে ঢাকায় দেখা করেন মিন্টু। কারণ শাহীনের সোনা চোরাচালানের একটি বড় অঙ্কের টাকা মেরে দিয়েছিলেন আনার। এ কারণে তার ওপর ক্ষোভ ছিল শাহীনেরও।
তাকে বলা হয়, আনার সরে গেলে মহেশপুর সীমান্তের চোরাকারবারের দায়িত্ব দেয়া হবে তাকে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন গ্যাস বাবুও। শাহীনও লোভ পড়ে ও পূর্বশত্রুতার কারণে রাজি হয়ে যান। এরপর চরমপন্থি নেতা শিমুল ভূঁইয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
বেশ কয়েক বছর আগে শিমুলের ভগ্নিপতি পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির (লাল পতাকা) ডা. টুটুল কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। শিমুল মনে করেন, ওই ঘটনায় আনারের হাত রয়েছে। আর এ কারণে আনারকে খুনের প্রস্তাব লুফে নেন তিনি।
হত্যার আগে-পরে খরচ হয় ৫০ লাখ টাকা :
মিন্টু ও গ্যাস বাবুকে জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে তদন্তকারী সূত্র জানায়, এমপি আনারকে হত্যার জন্য চুক্তি হয় ৫ কোটি টাকার। মূলত আওয়ামী লীগ নেতা গ্যাস বাবুর মাধ্যমেই খুনিদের সঙ্গে কথাবার্তা চূড়ান্ত করা হয়।
গ্যাস বাবু খুনি শিমুলের সঙ্গে কথা বলেন। আনারকে হত্যা করতে পারলে সবাইকে ৫ কোটি টাকা দেয়া হবে বলে প্রস্তাব দেন বাবু। নেপথ্যে থাকা প্রভাবশালীরা পুরো ৫ কোটি টাকা দেন মিন্টুর কাছে।
আর মিন্টু অর্থ দেন গ্যাস বাবুর কাছে। আর গ্যাস বাবু দেন শাহীনের কাছে। চুক্তি অনুযায়ী অগ্রিম দেয়া হয় ২ কোটি টাকা। পরিকল্পনা চূড়ান্ত হওয়ার পর মিন্টুর পক্ষ হয়ে শাহীনের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছিলেন গ্যাস বাবু। আর শিমুলের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছিলেন শাহীন। সবকিছু চূড়ান্ত হওয়ার পর শাহীন ও শিমুল যান কলকাতায় বাসা ভাড়া করতে।
কিন্তু সেখানে পরিবার ছাড়া বাসা ভাড়া পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে তারা শিলাস্তি রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাকে কলকাতায় ডেকে নেন। সেখানে তাকে শাহীনের স্ত্রী হিসেবে উপস্থাপন করে বাসা ভাড়া করা হয়। পরে এই শিলাস্তির মাধ্যমে আনারকে ‘হ্যানি ট্রাপ’ করে কলকাতায় ডেকে নেয়া হয়।
আনার কলকাতায় যাওয়ার আগে থেকেই শিমুলের নেতৃত্বে ছয় খুনি ওই ফ্ল্যাটে অবস্থান করেন। পুরো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে ৫০ লাখ টাকার মতো খরচ করেন শাহীন। তিনি কলকাতা ত্যাগ করার আগে শিমুলকে বলেছিলেন হত্যার পর শাহীন, মিন্টু ও গ্যাস বাবুকে ছবি দেয়ার পরই পুরো টাকা দেয়া হবে। এ কথা বলে শাহীন চলে আসেন ঢাকায়।
সাড়ে ৪ কোটি টাকা মেরে শাহীন যুক্তরাষ্ট্রে :
আনারকে ওই ফ্ল্যাটে নিয়ে আসেন শিলাস্তি। সেখানে চেতনানাশক ওষুধ ব্যবহার করে আনারকে একটি চেয়ারে বেঁধে রাখা হয়। পরে বালিশচাপা দিয়ে হত্যার পর লাশ টুকরো করে গুম করে খুনিরা। এর আগে শাহীনের কাছে আনারের নিথর দেহের ছবি পাঠান শিমুল। শাহীন ওই ছবি পাঠান গ্যাস বাবুর কাছে।
এরপর চুক্তি অনুযায়ী বাকি টাকা চাওয়া হয়। পরে গ্যাস বাবু ওই ছবি পাঠান মিন্টুর কাছে। টাকা দেয়ার দিনক্ষণ চূড়ান্ত হয় ২৩ মে। এরই মধ্যে আনার খুনের ঘটনা প্রকাশ পায়। পরবর্তীকালে সবাই আত্মগোপনে চলে যান। আর শাহীন পুরো টাকা নিয়ে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে।
‘মিন্টু অর্থদাতা কি না জানতে চাওয়া হবে’ :
ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টু সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় অর্থদাতা ও নির্দেশদাতা ছিলেন কি না, তা উদঘাটন করা হবে জানিয়ে ডিএমপি ডিবির প্রধান বলেছেন, তদন্তে সুস্পষ্ট অভিযোগ না পেলে কাউকে ডাকেন না তারা
বৃহস্পতিবার ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, অভিযুক্ত খুনি শিমুল ভূঁইয়া ও গ্যাস বাবুর জবানবন্দিতে কিছু তথ্য পেয়েছি। এ কারণে মিন্টুকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। তাকে ব্যাপক আকারে জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন। সেই কারণে আমরা তাকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে সোপর্দ করি।’
ডিএমপির গোয়েন্দাপ্রধান বলেন, ‘মিন্টুকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসা করা হবে, তিনি হত্যাকাণ্ডের কতটুকু জানেন? গ্যাস বাবুর মোবাইল ফোন কেন ভেঙে ফেলা হলো সেটিও জিজ্ঞেস করা হবে। কিলার শিমুল ভূঁইয়া ঢাকায় আসার পর কেন মিন্টুর প্রতিনিধি গ্যাস বাবু তার সঙ্গে দেখা করলেন? টাকা-পয়সার লেনদেন সঠিক কি না? এ ছাড়া শাহীনের সঙ্গে কথা বলেছেন কি না?’
তিনি বলেন, ‘ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণবিষয়ক সম্পাদক গ্যাস বাবু রিমান্ডে রয়েছেন। তিনি স্বীকার করেছেন, আনার হত্যাকাণ্ডের মূল ঘাতকের সঙ্গে মিটিং এবং একাধিকবার দেখা করেছেন তিনি।