বাংলার ভোর প্রতিবেদক
বাংলাদেশ কৃষক সংগ্রাম সমিতির কেন্দ্রীয় সহ সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা ডা. আব্দুল খালেক লস্করের শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৃহস্পতিবার বিকেলে যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার জহুরপুর ইউনিয়নের বেতালপাড়া সম্মিলনী মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে এই শোকসভার আয়োজন করা হয়।
জেলা কৃষক সংগ্রাম সমিতির আয়োজনে বক্তারা বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা খালেক লস্কর ঐক্যের প্রতীক ছিলেন। নীতির কাছে অবিচল ছিলেন। নিজের আদর্শের প্রতি, নিজের বিশ্বাসের প্রতি, নিজের অবস্থানের প্রতি তার ছিল সততা। তৃণমূল মানুষের জন্য তিনি জীবনভর লড়ে গেছেন। তার এককালের সহযোদ্ধারা দল পরিবর্তন করে বিভিন্ন সরকারের সঙ্গে যোগ দিলেও খালেক লস্কর কখনো তার আদর্শ থেকে একচুল বিচ্যুত হননি।
খালেক লস্করের জীবনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে বক্তরা বলেন, সাধারণ মানুষের ওপর শোষক শ্রেণির নির্যাতন, শ্রমজীবী মানুষকে শোষণের অবসান হয়নি। খালেক লস্কর তার রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে শাসক শ্রেণির আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করে মুক্ত মানুষের জন্য মুক্ত সমাজ গঠনের লড়াই করে গেছেন। প্রগতিশীল বাম শক্তির ঐক্যের মধ্য দিয়ে সাম্যবাদী সমাজ গড়ে তোলার সংগ্রামে প্রেরণা হয়ে থাকবেন তিনি।
বাংলাদেশ কৃষক সংগ্রাম সমিতি যশোরের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সোহরাব উদ্দিন মাস্টারের সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন ধ্রুবতারা সাংস্কৃতিক সংসদের সভাপতি শ্যামল কুমার ভৌমিক, কৃষক সংগ্রাম সমিতির সভাপতি হাফিজুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান কবির, নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি শাহ আলম ভুইয়া, ট্রেড ইউনিয়ন সংঘের সহ সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ দত্ত, আব্দুল খালেক লস্করের বড় ছেলে নেওয়াজ শরীফ, মেজো ছেলে সাংবাদিক সাইফ উদ দৌলা রুমি, সেজো ছেলে ও জাতীয় ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় সদস্য নাজিম উদ দৌলা সাদি, ছোট ছেলে রাকিব উদ দৌলা রাব্বি, শোকসভা বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক ইবাদত হোসেন মুন্সি প্রমুখ।
গত ১৮ জুন বুধবার দুপুরে যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার জহুরপুর ইউনিয়নে নিজ বাসায় মুক্তিযোদ্ধা ডা. আব্দুল খালেক লস্কর মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর। দীর্ঘদিন ধরে তিনি বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় শয্যাশায়ী ছিলেন।
পরিবার সূত্রে জানাগেছে, আমৃত্যু বিপ্লবী প্রখ্যাত কৃষকনেতা ডা. আব্দুল খালেক লস্কর ১৯৪২ সালে ১৫ নভেম্বর যশোর জেলার বাঘারপাড়া থানার জহুরপুর ইউনিয়নের চাঁদপুর গ্রামে সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা আজিজুর রহমান লস্কর ছিলেন এলাকার ভূস্বামী।
আব্দুল খালেক লস্কর ১৯৫০ সালের দিকে প্রেমচারা প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষে খাজুরা এমএন মিত্র মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন। তিনি একজন কৃতি ফুটবলারও ছিলেন। খাজুরা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে পরিচয় হয় সংগ্রামী নেতা কমরেড আমজাদ হোসেনের সঙ্গে। ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনে তার সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং ১৯৭০ সালের নির্বাচন বর্জন প্রক্রিয়ায় সামিল ছিলেন। তিনি ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টিতে (এমএল) যোগ দেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন খালেক লস্কর।
দেশ স্বাধীনের পর যুবলীগ-রক্ষীবাহিনীর অপতৎপরতার বিরুদ্ধে তিনি শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এ সময় তার নেতৃত্বে এলাকা মুক্তাঞ্চল ঘোষিত হয়। তার এলাকায় পার্টির নেতৃত্বে বিচার কমিটি গঠিত হয়। ওই কমিটির সভাপতি হিসেবে মকসেদ আলী মোল্যাকে মনোনিত করা হয়। এই কমিটির সিদ্ধান্তে এলাকার ভূ-স্বামীদের ফসল দখলের কর্মসসূচি গ্রহণ করা হয়। অসংখ্য গরিব ও ভূমিহীন কৃষকদের অংশগ্রহণে প্রথমে তার বাবা আজিজুর রহমান লস্করের জমির ফসল কেটে নেয়া হয়। এ ঘটনার পর এলাকায় ব্যাপক পুলিশ-রক্ষীবাহিনী তাণ্ডব শুরু হয়। গ্রেফতার এড়াতে আব্দুল খালেক লস্কর ঝিনাইদহ জেলার হলিধানী বাজারে ঘরভাড়া নিয়ে ডাক্তারি শুরু করেন।
সত্তরের দশকের শেষের দিকে অস্ত্র মামলায় গ্রেফতার এবং পাঁচ বছরের সাজা হয় তার। ১৯৮২ সালে তিনি কারামুক্ত হন। কারামুক্ত হয়ে তিনি কিছুদিন মাগুরায় চিকিৎসা সেবা দিতেন এবং কৃষক সংগ্রাম সমিতির মাগুরা জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় সদস্য হিসেবে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতেন। পার্টি করার কারণে স্থানীয় আওয়ামী-যুবলীগের লোকেরা তার গ্রামের বাড়িতে ব্যাপক ভাঙচুর, লুটপাট ও পরিবারের সদস্যদের মারপিট পর্যন্ত করে। বাড়ির গরু-বাছুর লুট করে নিয়ে যায়। তিনি ২০১০ সালে কৃষক সংগ্রাম সমিতির যশোর জেলা কমিটির সভাপতি, এরপর কেন্দ্রীয় সদস্য, ২০১৬ সালে কেন্দ্রীয় কোষাধ্যক্ষ, জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের যশোর জেলা সহ-সভাপতি ও সর্বশেষ ২০১৯ সালের কেন্দ্রীয় সম্মেলনে কৃষক সংগ্রাম সমিতির কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন।