বাংলার ভোর প্রতিবেদক
আসন্ন ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে যশোরে ৬টি আসনের মধ্যে পাঁচটিতে প্রাথমিক দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করেছে বিএনপি। প্রার্থী ঘোষণার পরে বঞ্চিতরা মনোনয়ন পাওয়া নেতাদের পক্ষে কাজ করার ইঙ্গিত দিলেও কথা রাখেননি কেউ। সদর ছাড়া বাকি পাঁচ আসনে চূড়ান্ত মনোনয়নের আশায় এখনও আসনগুলোতে একডজন নেতা কোমর বেঁধে মাঠে রয়েছেন। নেতাদের সমর্থকরা প্রার্থিতা বদলের দাবিতে মহাসড়ক অবরোধ, বিক্ষোভ মিছিল, সমাবেশসহ নানা কর্মসূচি পালন করছেন। এতে তৃণমূলে বিভেদের পাহাড় উঁচু হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে অবাধ্য মনোনয়নপ্রত্যাশীদের বিরুদ্ধে কঠোর হচ্ছে যশোর জেলা বিএনপি। ইতোমধ্যে তিন প্রার্থীসহ ১০ নেতাকে শোকজ করা হয়েছে। জেলা বিএনপির নীতিনির্ধারকরা জানিয়েছেন, দলের সিদ্ধান্তের বাইরে যেয়ে বিশৃঙ্খলা করলে তাদের বিরুদ্ধে নেয়া হবে কঠোর ব্যবস্থা।
যশোর জেলা বিএনপির সভাপতি সাবেরুল হক সাবু বলেন, ‘দল যাদের প্রাথমিক মনোনয়ন দিয়েছে; তাদের বিরুদ্ধে যাওয়ার সুযোগ নেই। মনোনয়ন নিয়ে প্রতিযোগিতা থাকবে; কিন্তু দলের প্রশ্নে এক থাকতে হবে। যারা থাকবে না; তাদের দলে থাকার সুযোগ নেই। ইতোমধ্যে তিন প্রার্থীসহ ১০ নেতাকে শোকজ করা হয়েছে। দলের হাই কমান্ডের সিন্ধান্ত চূড়ান্ত।’
যশোর-১ (শার্শা) আসনে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন চার জন। গত বছরের রাজনীতিক পটপরিবর্তনের পর থেকেই এই চারজনই নিজ নিজ বলয় নিয়ে মাঠ গোছানোর কাজ করেছেন। কিন্তু আসনটিতে বিএনপি সম্ভাব্য মনোনয়ন পেয়েছেন সাবেক সংসদ সদস্য ও বিএনপির সাবেক দপ্তর সম্পাদক মফিকুল হাসান তৃপ্তি। মনোনয়ন পেয়ে তিনি ভোটের মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। মনোনয়ন না পাওয়ায় হতাশ শার্শা উপজেলা বিএনপির সভাপতি আবুল হাসান জহির, সাবেক সভাপতি খায়রুজ্জামান মধু, সাধারণ সম্পাদক নুরুজ্জামান লিটনের অনুসারীরা। দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে নেয়ার ঘোষণা দিলেও বাস্তবে তারা তৃপ্তির প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন না। চূড়ান্ত মনোনয়নের আশায় এই তিন প্রার্থীই কোমর বেঁধে নতুন করে মাঠে নেমেছেন। মনোনয়ন পরিবর্তন চেয়ে দলীয় হাই কমান্ডের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। তৃপ্তির মনোনয়ন পরিবর্তের জন্য বঞ্চিত উপজেলা বিএনপির সভাপতি হাসান জহির ও সাধারণ সম্পাদক নুরুজ্জামানের অনুসারীরা বিক্ষোভ কর্মসূচি করে। অব্যাহত কর্মসূচির অংশ হিসেবে গত ২৯ নভেম্বর যশোর-বেনাপোল মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। এতে নানা সমালোচনার মুখে পড়েন জহির ও নুরুজ্জামান। এই দুই প্রার্থীকে থামাতে তার পরের দিন শোকজ করে বিএনপি। শোকজের জবাব সন্তোষজনক এবং পরবর্তীতে দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গেলে নেয়া হয়ে পারে কঠোর সাংগঠিনিক সিন্ধান্ত বলে জানিয়েছে দলের একটি সূত্র।
যশোর-২ (ঝিকরগাছা-চৌগাছা) আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য, উপজেলা বিএনপির সভাপতি সাবিরা সুলতানা মুন্নী। দলীয় মনোনয়ন পেয়েই একবার ঝিকরগাছা আরেকবার চৌগাছার প্রত্যন্ত অঞ্চলে ধানের শীষের পক্ষে ভোট চাইতে ছুটে বেড়াচ্ছেন মুন্নী। তবে আসনে প্রার্থী পরিবর্তনের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন মনোনয়নপ্রত্যাশী অন্যরা। প্রার্থী পরিবর্তনের আবেদন জানিয়ে গত ১০ নভেম্বর দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বরাবর আবেদন করেছেন ঝিকরগাছা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ইমরান সামাদ নিপুন ও চৌগাছা উপজেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুল সালাম। নতুন করে মনোনয়নের দাবিতে গত শুক্রবার আসনটিতে মোটরসাইকেল শো ডাউন দেন যশোর চেম্বার অব কমার্স অ্যাণ্ড ইণ্ডাস্ট্রিজের সভাপতি ও জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক মিজানুর রহমান খান। পৃথক কর্মসূচি করে বেড়াচ্ছেন আরেক প্রার্থী চৌগাছা উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি জহুরুল ইসলামও। আসনটিতে মনোনয়ন বঞ্চিতদের থামাতে ইতোমধ্যে দুই উপজেলার যুবদল ও ছাত্রদলের শীর্ষ নেতাদের শোকজ করা হয়েছে।
টিএস আইয়ুবের মনোনয়ন বাতিলের দাবিতে উপজেলাতে নানা কর্মসূচি বিক্ষোভ করছেন। টিএস আইয়ুবের বিরুদ্ধে দিচ্ছেন নানা বক্তব্য। ফারাজী মতিয়ারকে থামাতে ইতোমধ্যে মতিয়ারসহ নওয়াপাড়া পৌর বিএনপির সভাপতি আবু নইমকে শোকজ করেছে যশোর বিএনপি। দলীয়ভাবে নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও বিএনপি’র প্রাথমিক মনোনয়নপ্রাপ্ত প্রার্থীর বিরুদ্ধে অশালীন মন্তব্য করা এবং সভা-সমাবেশ আয়োজনের অভিযোগ আনা হয়েছে আবু নইমের বিরুদ্ধে।
যশোর-৫ (মণিরামপুর) আসনে বিএনপি প্রার্থী ঘোষণা করেনি। এই আসন জোটের শরিক দলের জন্য ছেড়ে দেয়া হবে, নাকি শেষ মুহূর্তে দলের কোনো চমক থাকছে, সেটি পরিষ্কার নয়। গুঞ্জন রয়েছে জোটের শরিক জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সহকারী মহাসচিব ও এই আসনের সাবেক এমপি, সাবেক ধর্ম প্রতিমন্ত্রী মুফতি ওয়াক্কাসের ছেলে মাওলানা রশিদ আহমাদকে আসনটি ছেড়ে দেয়া হবে। যদিও আসনটি বিএনপির প্রার্থী ঘোষণার দাবি তৃণমূলের। শেষ পর্যন্ত বিএনপির প্রার্থী ঘোষণা হবে এমন আশায় এখনও মাঠে কাজ করছেন বিএনপির উপজেলা বিএনপির সভাপতি অ্যাড. শহিদ মোহাম্মদ ইকবাল, সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান মিন্টু, স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ইফতেখার সেলিম অগ্নি।
যশোর-৬ (কেশবপুর) আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি রওনাকুল ইসলাম শ্রাবণ। প্রায় একযুগ পরে এলাকায় ফিরে তিনি গণসংযোগ শুরু করেছেন। এই আসনের দুজন প্রার্থী বিএনপির কেন্দ্রীয় সহধর্মবিষয়ক সম্পাদক অমলেন্দু দাস অপু ও কেশবপুর উপজেলা বিএনপির সভাপতি আবুল হোসেন আজাদ মনোনয়ন না পাওয়ায় অনুসারীরা এখনো শ্রাবণের পক্ষে কাজ করতে দেখা যায়নি। তারা মনোনয়ন পাওয়ার আশায় নতুন করে সভা সমাবেশ ও নানা কর্মসূচি করছেন। বিএনপির একটি সূত্র বলছে, অবাধ্য মনোনয়নপ্রত্যাশীদের বিরুদ্ধে কঠোর যশোর জেলা বিএনপি। সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়ায় অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। তৃণমূলের নেতাকর্মীরা বলছেন, প্রাথমিক মনোনয়ন নিয়ে সদর ছাড়া বাকি ৫ আসনে দলটির তৃণমূলে বিভেদ এখনো কাটেনি। প্রাথমিক মনোনয়ন পাওয়া নেতারা এলাকায় অর্থ খরচ করছেন। আবার মনোনয়নবঞ্চিতরাও খরচ করছেন মনোনয়ন পাওয়ার আশায়। এই আশাবাদী নেতাদের সমর্থকরা প্রার্থিতা বদলের দাবিতে মহাসড়ক অবরোধ, বিক্ষোভ মিছিল, সমাবেশসহ নানা কর্মসূচি পালন করছেন। কয়েকটি আসনে ঘোষিত সম্ভাব্য একক প্রার্থীর সমর্থকরাও পালটা কর্মসূচি দিয়ে মাঠে থাকছেন। সব মিলিয়ে এতে দলটির ক্ষতি হচ্ছে। পক্ষান্তরে লাভবান হচ্ছে নির্বাচনে বিএনপির প্রতিদ্বন্দ্বী জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যরা।
যশোর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন খোকন বলেন, ‘ দলীয় প্রধান সংকটময় মূর্হতে থাকায় এখন কেউ নির্বাচনী কর্মসূচি করছেন না। আগে একে অন্যের বিরুদ্ধে কর্মসূচি করলেও; কয়েক প্রার্থীসহ কিছু নেতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়াতে অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। তিনি বলেন, ‘মনোনয়ন না পাওয়া মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে ক্ষোভ হতাশা রয়েছে। তবে চুড়ান্ত মনোনয়ন দেয়ার পর থেকে নেতাকর্মীরা ব্যক্তি নয়; সবাই ধানের শীর্ষের পক্ষে কাজ করবে।’
