প্রতীক চৌধুরী ও হাসান আদিত্য
চলতি বছরের পহেলা জুলাই কৃষিক্ষেতে নিজ জমিতে কাজ করছিলেন যশোর অভয়নগরের প্রেমবাগ ইউনিয়নের বনগ্রামের বাসিন্দা ফশিয়ার রহমান মোল্যা। এ সময় গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির সঙ্গে হঠাৎ বজ্রপাতে মাটিয়ে লুটিয়ে পড়েন তিনি। ২০২৩ সালের ২৭ এপ্রিল ধানক্ষেতে কাজ করার সময় মারা যান আজিজুল ইসলাম (৩৫)। তিনি যশোরের শার্শা উপজেলার পাড়ের কায়বা গ্রামের কামাল সর্দারের ছেলে। একই বছরের ২২ জুলাই মাঠে কাজ করার সময় বজ্রপাতে মারা যান আরেক কৃষক মণিরামপুরের আরাজী গয়েশপুরের কাসেম আলী (৫৪)।
শুধু এই তিন কৃষক নয়, গত ১১ বছরে যশোরে বজ্রপাতে ৪৫জন পুরুষ, নারী ও শিশু মারা গেছেন। মৃত ব্যক্তিদের মধ্যে ২৫জনই কৃষক। যা গড় মৃত্যুর ৫৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ কৃষক। বাকিরা গৃহিনী, শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী, দিনমজুর, মৎস্যজীবী ও পশু চিকিৎসক। বজ্রপাতে মৃত্যু রোধে সরকারের কার্যকর পদক্ষে গ্রহণের দাবি বিশেষজ্ঞদের। বজ্রপাতকে দুর্যোগ ঘোষণা করে গবেষণা, নীতি নির্ধারণ ও সচেতনতা বৃদ্ধিতে জোর দিতে হবে।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন অফিসের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১৫ সাল থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত (আগস্ট) ১১ বছর যশোর জেলায় বজ্রপাতে ৪৫জন মারা গেছেন। আহত হয়েছেন আরও ৭জন। হতাহতদের মধ্যে নারী ছয়জন, পুরুষ ৩৭জন ও শিশু দুইজন। সবচেয়ে বেশি হতাহত চৌগাছা উপজেলায় ১২জন। সবচেয়ে কম কেশবপুর উপজেলায় একজন মারা গেছেন। এছাড়াও সদরে সাতজন, মণিরামপুরে ছয়জন, অভয়নগরে চারজন, শার্শায় সাতজন, ঝিকরগাছায় চারজন, বাঘারপাড়ায় চারজন হতাহত রয়েছে। মৃত ৪৫ ব্যক্তির মধ্যে ২৫ জনই কৃষক। যা গড় হিসেবে ৫৫ দশমিক ২৬ শতাংশ। আহত হয়েছেন আরও ৫জন কৃষক।
বাকিরা শিক্ষার্থী, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, দিনমজুর, পশু চিকিৎসক, গৃহীনী ও মৎস্যজীবী। মৃতদের বয়স ১২ বছর থেকে ৭০ বছরের মধ্যে। তাদের অধিকাংশই ফসলের ক্ষেত, বাড়ি, খেলার মাঠ, জলাশয়ে বজ্রপাতে আক্রান্ত হয়েছে। এপ্রিল থেকে অক্টোবর মাসের মধ্যেই তারা বজ্রপাতে হতাহত হন। তাদের সিংহভাগই গ্রামের বাসিন্দা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, আহত ও মৃত ব্যক্তিদের মধ্যে যারা সরকারি অনুদানের টাকা নিয়েছেন, শুধুমাত্র তাদের নাম লিপিবদ্ধ করেছে ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার কার্যালয়। প্রকৃত মৃতের সংখ্যা আরও বেশি। বজ্রপাতে মৃত ব্যক্তির পরিবার সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা ও আহত ব্যক্তি সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকার সরকারি অনুদান পেয়েছেন।
বজ্রপাতে কৃষক মৃত্যুর হার বেশি কেন জানতে চাইলে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. ইঞ্জিনিয়ার মো. রাহিদুল ইসলাম বলেন, আমাদের দেশে বজ্রপাতে মৃতের ৩০-৩৫ শতাংশই কৃষকই।
২০২২ সালের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বজ্রপাতে মৃত ৩৪৭জনের মধ্যেই ১৪৭জন কৃষক ছিল। যা প্রায় ৪০ শতাংশ। সময়, স্থান ও সচেতনতার অভাব- তিনটি কারণে বজ্রপাতে কৃষক মৃত্যুর বেশি। বাংলাদেশ এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত বোরো ধান কাটার সময়। আর সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত আমন ধান কাটার মৌসুম। ওই দুটি মৌসুমে কৃষকরা খোলা আকাশের নিচে মাঠে কাজ করে। ওই সময়েই বেশি বজ্রপাত হয়। ফলে বজ্রপাতে কৃষকের মৃত্যু বেশি হয়। সমতলের ভূমি ও জলাশয় এলাকায় বজ্রপাতের প্রবণতা বেশি। যেমন যশোর, চুয়াডাঙ্গা, সিরাজগঞ্জ, নাটোর এলাকায় বজ্রপাতে বেশি সংখ্যক কৃষক মারা যান। বজ্রপাতে কৃষক মৃত্যুর আরেকটি কারণ-সচেতনতার অভাব। বজ্রপাত কখন হবে, কোন ধরণের মেঘে বজ্রপাত হবে, মেঘ দেখলে বুঝতে পারবে কৃষক। বজ্রপাতের মেঘ দেখে কৃষকরা নিরাপদ জায়গায় আশ্রয় নিবে, এটা তারা জানে না।
তাদেরকে এ ব্যাপারে বোঝানোর জন্য সরকারের সচেতনতামূলক কর্মসূচি খুবই কম। ফলে বজ্রপাত কৃষকদের মৃত্যু ফাঁদ হয়ে গেছে। আবার কেউ কেউ সচেতন হলেও দারিদ্রতা ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার কারণে ইচ্ছা করলেও বজ্রপাতের আশংকা দেখা দিলে ওই সময় কাজ বাদ দিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার কথা চিন্তা করতে পারে না। জমির মালিকও বিষয়টি মেনে নিতে চান না। আগে অনেক বড় বড় গাছ থাকতো। এখন বড় গাছ নেই। তাল, খেজুর গাছও কমেছে। বজ্রপাত শুরু হলে-আশেপাশের বড় গাছ প্রতিরোধ করত। এখন বজ্রপাত প্রতিরোধে গাছ না থাকায় সরাসরি মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে।’
সহযোগী অধ্যাপক ড. ইঞ্জিনিয়ার মো. রাহিদুল ইসলাম বলেন, বজ্রপাতকে দুর্যোগ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। দুর্যোগ প্রশমনের ব্যবস্থা নিতে হবে। বজ্রপাত নিয়ে গবেষণা, পলিসি নির্ধারণ ও সচেতনতা বাড়তে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে।
বজ্রপাতে কৃষক মৃত্যু কমাতে কি পদক্ষেপ নিচ্ছে জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোশাররফ হোসেন বলেন, বজ্রপাতে প্রাণহানি এড়াতে কৃষকদের সচেতনতা বৃদ্ধিতে আমরা কাজ করছি। বজ্রপাতের সময় নিরাপদ আশ্রয়ে থাকার পরামর্শ দেয়া হয়। বজ্রপাত প্রতিরোধে তাল ও খেজুর গাছের চারা রোপণে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করছি।’
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা শেখ আবদুল কাদের বলেন, বজ্রপাতে নিহতের পরিবারকে এককালীন অনুদান সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকার সরকারি অনুদান প্রদান করা হয়। গত ১০ বছরে জেলার ৪৩জনকে অনুদান প্রদান করা হয়েছে। এ বছরের এখনো দেয়া হয়নি।’

