বাংলার ভোর প্রতিবেদক
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য রেলের মতো ভারি বাহনের যন্ত্রাংশ তৈরি হচ্ছে খোদ যশোরে। শুধু তাই নয় তৈরি হচ্ছে শিল্প কলকারখানায় ব্যবহৃত বিভিন্ন মেশিনের যন্ত্রাংশ। দক্ষিণের এ জেলায় ৫ শতাধিক প্রতিষ্ঠানে এসব পণ্য তৈরি হওয়ায় কমছে আমদানি, সাশ্রয় হচ্ছে ৬০০ কোটি টাকা সমমূল্যের বৈদেশিক মুদ্রা। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অনুরোধ করে আলাদা শিল্প পার্ক স্থাপনের দাবি উদ্যোক্তাদের।
শহরতলীর রাজারহাট রিপন ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপে তৈরি হচ্ছে রেলের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ। যেগুলো আগে আমদানি করতে হতো। পাশাপাশি এ কারখানা তৈরি হয় পাথর ও ইট ভাঙা মেশিনসহ গাড়ির যন্ত্রাংশ। কেবল এ প্রতিষ্ঠানেই নয়, এমন ৫ শতাধিক প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত লোহার স্ক্রাব গলিয়ে এবং সেই তরল লোহা নতুন ফর্মায় ঢেলে তৈরি করা হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রাংশ। বিশেষ করে শিল্প কল কারখানায় ব্যবহৃত যন্ত্রাংশ, ওয়ার্কশপ মেশিনারি, অটোমোবাইল, স্পেয়ার পার্টস, কৃষি যন্ত্রপাতি ও খুচরা যন্ত্রাংশ, লৌহঘটিত ও অলৌহঘটিত কাস্টিং পণ্য, ছাঁচ ও ডাই, নির্মাণ যন্ত্রপাতি, সিমেন্ট মিলের খুচরা যন্ত্রাংশ, জাহাজ ও ফিশিং ট্রলারের খুচরা যন্ত্রাংশ, মুদ্রণ ও প্যাকেজিং যন্ত্রপাতি, মেশিন ও সরঞ্জামের প্রায় সব বিভাগের জন্য খুচরা যন্ত্রাংশ, কারখানার যন্ত্রপাতি, টেক্সটাইল যন্ত্রপাতিসহ বিভিন্ন যন্ত্রাংশের চাহিদা মেটাতে আমদানিই ছিল একমাত্র ভরসা। কিন্তু সেই নির্ভরতা অনেকটা কমে এসেছে।
এখন যশোরের বিভিন্ন হালকা প্রকৌশল শিল্প কারখানা গুলোয় তৈরি হচ্ছে এ ধরনের দুই শতাধিক যন্ত্রাংশ। যা গুণতগত মানেও উন্নত। সারাদেশে যশোর অঞ্চলের লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্যের ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়েছে। এতে করে ভারত ও চীন থেকে হালকা প্রকৌশল পণ্য আমদানি কমেছে।
বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প মালিক সমিতির সিনিয়র সহ সভাপতি সিরাজ খান মিন্টু বলেন, বর্তমানে যশোরে ছোটবড় মিলিয়ে ৫ শতাধিক ওয়ার্কশপে ২০ হাজারেরও বেশি মানুষ কাজ করেন। ওয়ার্কশপগুলোতে পণ্য উৎপাদনের পাশাপাশি আমদানিকৃত পণ্য মেরামতও করা হয়। উৎপাদিত পণ্যসামগ্রির মধ্যে পাথর ও খোয়াভাঙা মেশিন, ধান ও ভুট্টা ভাঙানো মেশিন, মুড়ি মেশিন, কৃষি পাম্প, টিউবয়েল, পাওয়ার টিলার, বিছালি কাটা মেশিন, চিনি ও তুষ পাউডার মেশিন, কেক মিকচার, জাহাজের পাখা, মোটরসাইকেল ও বাইসাইকেলের চাকার রিমের মতো অতি প্রয়োজনীয় সামগ্রি রয়েছে। শতাধিক রকমের গাড়ির পার্টসও উৎপাদিত হয় এখানে। যার মধ্যে গাড়ির ব্রেকড্রাম, পেসারপ্লেট, গিয়ারবক্স, ব্রেকডিস্ক, ইঞ্জিন হাউজিং, হ্যাঙ্গার, স্প্রিংপাতি, গিয়ার বক্সের বডি অন্যতম।
এছাড়া জুট, রাইস, টেক্সটাইল ও সিমেন্ট মিলের পার্টসও এখানকার কারখানায় উৎপাদিত হয়। সর্বনিম্ন ৫০০ টাকা থেকে ৫ হাজার টাকা দাম এসব পার্টসের- যোগ করেন তিনি। তিনি আরও বলেন, ‘আমদানি করা হারভেস্টার মেশিনের যন্ত্রাংশও তৈরি করছি। হারভেস্টার একটা পার্টস কিনতে যেখানে ১৫ হাজার টাকা লাগে, আমরা সেটা মাত্র ৪-৫ হাজার টাকায় তৈরি করে দিচ্ছি।’
বাবু ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের আকবার আলী বাবু বলেন, ‘আমরা যেসব মেশিনারিজ তৈরি করি তার অধিকাংশই আগে ভারত থেকে আমদানি হতো। ভারত ও চীন থেকে আমদানিকৃত লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্যের দাম বেশি। ক্রেতারা বেশি দামের পণ্য নিতে চান না। তারা যশোরে উৎপাদিত পণ্য কিনতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। হামিদ ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপের মালিক আব্দুল হামিদ বলেন, প্রয়োজনীয় সব যন্ত্রপাতি আমরা উৎপাদনে সক্ষম। ইতিমধ্যে আমদানি নির্ভরতা ৫০ শতাংশ কমেছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত আমদানি নির্ভরতা কমানো সম্ভব। এজন্য যশোরে সকল ওয়ার্কশপগুলো একছাতার নিচে আনতে পৃথক শিল্প পার্ক গড়ে তুলতে হবে।
এসএম এগ্রো ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপের মালিক মোহন আলী বলেন, ‘আমি মূলত কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরি করি। বছরে আমরা ১০ কোটি টাকার উপরে যন্ত্রাংশ বিক্রি করে থাকি। সরকার যদি আমাদের স্বল্প সুদের ঋণ ও ভর্তুকি মূল্যে ক্যাপিটাল মেশিনারিজ দিত তাহলে আমরা এ খাতকে আরও উন্নত করতে পারতাম।’ বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প মালিক সমিতির সভাপতি আশরাফুল ইসলাম বাবু বলেন, ‘আমাদের নানা সমস্যা রয়েছে। এ শিল্পকে এগিয়ে নিতে ক্যাপিটাল মেশিনারিজ দরকার। পাশাপাশি শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। যা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া সম্ভব না। আমরা চাই সরকার ভর্তুকি দিয়ে আমাদের শিল্পের অগ্রগতি ত্বরান্বিত করুক। এটা যদি হয় তাহলে আমরা আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে রপ্তানিমুখি হতে পারব।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যে ৬শ’ কোটি টাকার পণ্য উৎপাদন করছি। এতে করে সমমূল্যের বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় সম্ভব হয়েছে।’
এদিকে,যশোর চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি মিজানুর রহমান খান বলেন, ‘যশোরের লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে হলে উন্নতমানের মেশিনারিজ আমদানিতে সহযোগিতা দিতে হবে। এর পাশাপাশি দ্রুত বি-ট্যাকের কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হবে এবং পৃথক শিল্প পার্ক গড়ে তুলতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা ইতিমধ্যে কিছু প্রস্তাবনা মন্ত্রণালয় পাঠিয়েছি। এই শিল্পের উন্নয়নে ব্যবসায়ী সংগঠন হিসেবে আমরা সব উদ্যোগ নিতে বদ্ধপরিকর।’