শরিফ ইসলাম
‘আপনার কয়জন লাগবে স্যার?’ কি কাজ করাবেন। আমরা ৬ জন আছি। মাটি কাটা, মাটি ফেলা, লেবারি সব করতে পারি। সকাল বেলা ঘড়িতে বাজে কাঁটায় কাঁটায় আটটা। শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে শহরে যানবাহন ও মানুষের ভিড়ভাট্টা নেই বললেই চলে। শহরের প্রাণকেন্দ্রে সড়কের পাশে স্থানটির নাম লাল দীঘির পাড়। সেখানে একটি বন্ধ দোকানের সামনে ২৫-৩০ জন লোকের জটলা। তাদের সামনে রয়েছে বাইসাইকেল ও কোদাল-ভারশিকা। এসব উপকরণ দেখে বুঝতে বাকি থাকল না যে, তারা সবাই শ্রমজীবী মানুষ। তাদের কাছে যাওয়ার আগে তারাই ছুটে আসলেন।আলাপচারিতায় জানা গেল, তারা সবাই খেটে খাওয়া মানুষ। তাদের কারও বাড়ি শহরের কাছাকাছি আবার কারও শহর থেকে ৫-৬ কিলোমিটার দূরে। প্রতিদিন সকালে কাজের সন্ধানে লাল দীঘির পাড়ে এসে জড়ো হন তারা। শহরের লোকজন এখানে এসে তাদের কাজে নিয়ে যান। প্রতিদিন সকাল ছয়টা থেকে শুরু হয়ে নয়টা পর্যন্ত চলে শ্রমিকের হাট।
সকাল নয়টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত কাজ করেন তারা। একেকজন শ্রমিক প্রতিদিন কাজ করে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা মজুরি পান। কাজ শেষে মজুরির টাকায় বাজার-সদায় করে বাড়ি ফেরেন। পরদিন সকালে আবারও গন্তব্য লালদীঘির পাড়। এভাবেই কাটছে জীবরে ঘড়ি।তবে প্রতিদিন সব শ্রমিকের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ে না। প্রতিদিন তারা সবাই কাজ পান না। যেদিন কাজ মেলে না, সেদিন বিষণ্ন মনে বাড়ি ফিরে যান তারা। বাড়ির লোকজন থাকে অনাহারে অর্ধাহারে। বাচ্চার কান্না তখন হয়ে ওঠে করুণ রোদন।
শহরের নাজির শংকরপুরের মশিয়ার রহমান বলেন, ‘বাড়িতে থাকলে এলাকায় প্রতিদিন কাজ মেলে না। লাল দীঘির পাড়ে শ্রমিক হাটে এলে প্রায় প্রতিদিনই কাজ মেলে। এ কারণে আমরা সকাল ছয়টা থেকে নয়টা পর্যন্ত কাজের জন্য লাল দীঘির পাড়ে অপেক্ষা করি। কাজ না মিললে কষ্ট নিয়ে বাড়িতে চলে যাই। নুন-ফ্যান দিয়ে চালিয়ে পার করি বৌ বাচ্চা নিয়ে দিনটি।
লালদীঘির পাড়ে কতদিন আগে শ্রমিকের হাট বসা শুরু হয়েছিল তা কেউ সঠিক জানেন না। তবে ২৫-৩০ বছর আগে থেকে লাল দীঘির পাড়ে শ্রমিকের হাট বসছে বলে জানান শ্রমিকরা। প্রতি বছরই হাটে শ্রমিক বাড়ছে। আগে বয়স্ক শ্রমিক বেশি আসত। এখন বয়স্ক শ্রমিক কমেছে। এসব শ্রমিক মাটিকাটা, বাসাবাড়িতে বাগান পরিস্কারসহ নানা রকমের কাজ করেন।
শ্রমিক কিনতে লাল দীঘির পাড়ে এসেছিলেন বেজপাড়া এলাকার বাসিন্দা শফিউল আলম। তিনি জানালেন, বাসার উঠানের পাশে মাটি দেবেন। তাই শ্রমিকের সন্ধানে এসেছেন।
শ্রমিক মোশারফ হোসেন বলেন, আমার বাড়ি বকচর এলাকার হুশতলা। শহর থেকে বাড়ির দূরত্ব প্রায় তিন কিলোমিটার। পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে লাল দীঘির পাড়ে শ্রমিক হাটে আসছি। এখানে প্রায় প্রতিদিনই কাজের সন্ধান মেলে। প্রতিদিন কাজ করে যা পাই তাতেই চার সদস্যের সংসার চলে।কাজীপুর গ্রামের বাসিন্দা গোলাম শেখ বলেন, ‘শীত কাজে আসার জন্যি মন চাই না। কাজ না করলি কী খাব? তাই কনকনে শীতে কাজের খোঁজে এখানে চলে আসিছি।
খোলাডাঙ্গার আবুল কালাম বলেন, ‘লাল দীঘির পাড়ে এসে লোকজন কাজের লোকের খোঁজ করেন। এ কারণে আমরা লাল দীঘির পাড়ে এসে গৃহস্থের জন্য বসে থাকি। আমরা মাটিকাটা, বাসা-বাড়ির নানা রকমের কাজ করি।
যতদিন খেটে খাওয়ার সামর্থ্য আছে, ততদিনই শ্রমের হাটে তাদের দাম। ভবিষ্যৎ ভাবার মতো না আছে মন মানসিকতা, না আছে ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করার সামর্থ্য। তাই ওসব ভাবনা ওপরওয়ালার হাতে ছেড়ে দিয়ে বর্তমানটুকু পরিবার পরিজন নিয়ে কোনোমতে পার করতে পারলেই খুশি এই খেটে খাওয়া মানুষগুলো।

Share.
Leave A Reply Cancel Reply
Home
News
Notification
Search
Exit mobile version