বাংলার ভোর প্রতিবেদক
যশোরের বাঘারপাড়া, অভয়নগর ও চৌগাছা উপজেলায় অসংখ্য হিন্দু বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও ডাকাতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। সোমবার বিকেল থেকে মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত এসব ঘটনা ঘটে। ভয়ে অনেকেই বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন। ধর্মীয় সংখ্যালঘু পরিবারের সদস্যরা জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে শংকায় রয়েছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে যশোর জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি দীপংকর দাস রতন বলেন, ধর্মীয় সংখ্যালঘু পরিবারের লোকজন চরম আতংকে দিন পার করছে। অসংখ্য পরিবারে হামলা, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট হয়েছে। আমরা অসংখ্য মানুষের ফোন পাচ্ছি। তাদের আর্তনাদ শুনছি। প্রশাসন বলতে কিছুই নেই, কার কাছে অভিযোগ দিবো বুঝতে পারছি না।
তিনি আরও জানান, বিএনপির নেতৃবৃন্দ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। তারা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার বিষয়ে সজাগ রয়েছে। তাদের ইউনিটগুলোর মাধ্যমে অনেক জায়গায় নিরাপত্তার ব্যবস্থাও করেছেন। এমন বাস্তবতাও আছে।
জানা যায়, সোমবার বিকেলে কয়েক শ’ লোক বাঘারপাড়া উপজেলার নারিকেলবাড়িয়া বাজারের অন্তত ২৫টি দোকানে হামলা চালায়। এর মধ্যে ২০টি দোকানের মালিক হিন্দু। হামলাকারীরা দোকান ভাঙচুর করে মালামাল লুট করে নিয়ে যায়।
সোমবার সন্ধ্যায় বাঘারপাড়া উপজেলার নারিকেলবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বাবলু কুমার সাহার বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করা হয়। এরপর রাতে ১০ থেকে ১২ জন রামদা ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে নারিকেলবাড়িয়া গ্রামের লিটন কুন্ডুর বাড়িতে ঢোকে। তারা অস্ত্রের মুখে বাড়ির লোকজনদের জিম্মি করে তিন ভরি স্বর্ণালংকার এবং নগদ দুই হাজার ৭০০ টাকা নিয়ে যায়। আজ সকালে একই গ্রামের শিমুল সাহার বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করা হয়। এ সময় তারা বাড়ির লোকজনের কাছে এক লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। পরে নারিকেলবাড়িয়া বাজারে গিয়ে হিন্দুদের অন্তত তিনটি দোকান ভাঙচুর করে।
নারিকেলবাড়িয়া ইউপির চেয়ারম্যান বাবলু কুমার সাহা সাংবাদিকদের বলেন, ‘হামলাকারীরা বাজারে আমার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে। মালামাল লুট করে নিয়ে যায়। এ সময় বাজারের অন্তত ২৫টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর ও মালামাল লুট করা হয়। এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে আছেন।’ সোমবার রাতে উপজেলার শালবরাট গ্রামের হিন্দুপাড়ায় হামলা চালায় ১০ থেকে ১২ জনের একটি দল। এই পাড়ায় ৬৫টি হিন্দু পরিবার বসবাস করে।
মুখে কালো কাপড় বেঁধে হাতে রামদা নিয়ে তারা পাঁচ থেকে ছয়টি বাড়িতে যায়। তারা দুটি পরিবারের কাছে চাঁদা দাবি করে। তাৎক্ষণিকভাবে টাকা দিতে না পারায় তারা একজন বৃদ্ধকে পিটিয়ে আহত করে। তারা একজনের বাড়ি থেকে তিনটি গরু এবং অপর একজনের বাড়ি থেকে দুটি ছাগল নিয়ে যায়।’ এই পাড়ার বেশ কয়েকজন বলেন, ভয়ে রাতে পাড়ার সবাই পাশের বাগানে কোনোরকমে ছিলেন। আজ সকালে পুরুষেরা পাড়া ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন। উপজেলার সেকেন্দারপুর গ্রামে গতকাল রাতে একদল মুখোশধারী তিনটি হিন্দু বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও লুটপাট করে।
সোমবার সন্ধ্যা থেকে ভোর রাত পর্যন্ত বাঘারপাড়া উপজেলার ধলগ্রাম ইউনিয়নের পাঁচটি গ্রামের ২০ থেকে ২৫টি হিন্দু বাড়িতে চার দফায় হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়েছে। ধলগ্রাম ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান সুভাষ দেবনাথের মানিকদোয়া গ্রামের বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে একদল লোক।
এ সময় তারা গোয়াল থেকে দুটি গরু নিয়ে যায়। এরপর রাতে একদল লোক আন্ধারকোটা গ্রামের দীপংকর বিশ্বাসের বাড়িতে চার দফা হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে। ওই বাড়ি থেকে চারটি গরু, ২৫টি হাঁস, ১৫টি মুরগি, ৪০টি হাঁসের ডিম, দুই বস্তা চাল এবং একটি বৈদ্যুতিক মোটর নিয়ে যায়। তাদের কাছে এক লাখ টাকা দাবি করা হয়। টাকা না পেয়ে তাদের ঘরের মধ্যে রেখে হামলাকারীরা পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিতে যায়। ঘরে থাকা ৫০ হাজার টাকা দিয়ে তাঁরা প্রাণে রক্ষা পান।
দীপংকর বিশ্বাস বলেন, ‘খবর পেয়ে হামলার কিছুক্ষণ আগে স্ত্রী ও দুই ছেলেকে নিয়ে অন্যত্র চলে এসেছি। বাড়িতে বৃদ্ধ মা-বাবা আছেন। খুব ভয়ে আছি। কবে বাড়ি ফিরতে পারব জানি না।’
বাঘারপাড়া উপজেলার নতুনগ্রামের স্বপন কুন্ডু, শেখর ঢালী, বল্লামুখ গ্রামের অরবিন্দু স্বর্ণালংকার, অমল স্বর্ণালংকার ও মোহন্ত কুন্ডুর বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর, স্বর্ণালংকার ও মালামাল লুটপাট করা করা হয়। এ ছাড়া সোমবার গভীর রাতে একদল লোক উপজেলার সুলতাননগর গ্রামের ঋষিপল্লির কয়েকটি বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও মালামাল লুট করে। মনিরামপুর উপজেলার আম্রঝুটা গ্রামের দিলীপ সিংহের বাড়িতে সোমবার রাতে হামলা চালায় একদল লোক।
এ সময় তারা তাঁর দোতলা বাড়িতে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। এর আগে সন্ধ্যায় একদল লোক উপজেলার খাটুয়াডাঙ্গা বাজারে দিলীপ সিংহের দুটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর এবং দোকানে থাকা মালামাল নিয়ে যায়।
যশোরের চৌগাছা উপজেলার বল্লভপুর গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের চাষ করা বাওড়ের (জলাশয়) প্রায় ৪০ লাখ টাকার মাছ লুট করেছে সন্ত্রাসীরা। সোমবার রাত থেকে সন্ত্রাসীরা বাওড়ের মাছ লুট শুরু করে। মঙ্গলবার বিকেল পর্যন্ত ২০০-২৫০ জন বাঁওড়ে জাল ফেলে মাছ লুট করে নিয়ে যায়। প্রকাশ্যে লুট হলেও ঠেকাতে পারেনি।
এ বিষয়ে বল্লভপুর মৎস্যজীবী সমিতির সদস্যরা জানান, এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা দীর্ঘদিন সরকারি ইজারা নেয়া বাঁওড়টি দখলের পাঁয়তারা করছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করার পর সন্ত্রাসীরা বাঁওড়ের মাছ লুট করে নিচ্ছে। বাঁধা দিতে যাওয়ার সাহস পায়নি আমরা। হিন্দু পল্লীতের রাতের আঁধারে হামলা চালানো হবে বলে হুমকি দেয়া হচ্ছে। জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে আমরা শংকিত।’
এদিকে, সোমবার বিকেলে একদল লোক অভয়নগর উপজেলার পায়রা ইউপির ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য বারান্দী গ্রামের মনিশংকর রায়ের বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর এবং নগদ টাকা ও স্বর্ণালংকার নিয়ে গেছে। মনিশংকর রায় বলেন, হামলাকারীরা কুড়াল দিয়ে গ্রিল কেটে ঘরে ঢোকে। তারা ব্যাপক ভাঙচুর চালায়। তারা নগদ চার লাখ টাকা ও সাত ভরি স্বর্ণালংকার নিয়ে গেছে।
সন্ধ্যার দিকে হামলাকারীরা পায়রা ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান বারান্দী গ্রামের বিষ্ণুপদ দত্তের বাড়ি ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেয়। পরে তারা বারান্দী গ্রামের রবিন বিশ্বাস, যুধিষ্ঠির বিশ্বাস ও মহেন বৈরাগীর বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে। অভয়নগর উপজেলার ধোপাদী গ্রামের ব্যবসায়ী কৃষ্ণ দত্তের বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করার পাশাপাশি স্বর্ণালংকার ও মালামাল লুট করা হয়।