বাংলার ভোর প্রতিবেদক
যশোর পানি উন্নয়ন বোর্ডের রেস্ট হাউজে স্ত্রী পরিচয়ে এক নারীকে নিয়ে অবস্থানকালে ধরা পড়ার ঘটনায় চলছে শহরজুড়ে নানা আলোচনা। রেস্ট হাউজে নারীসহ অবরুদ্ধ ওই ওসিকে লাঞ্ছিত করাসহ তার কাছ থেকে রেস্ট হাউজ এলাকার একটি চক্র মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলেও গুঞ্জন উঠেছে। ঘটনার সময়ের সিসিটিভি ফুটেজেও ঘটনার অনেকটাই পরিস্কার হয়ে উঠেছে। তবে গোপন তদন্ত করছে ডিএসবি এমন দাবি করেছে একটি সূত্র।
অনৈতিক কর্মকান্ডের অভিযোগ তুলে স্থানীয় চক্র ওসিকে অবরুদ্ধ করে রাখার ঘন্টা খানেক পরে যশোর কোতোয়ালি থানা পুলিশ ও পাউবোর দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা যান ঘটনাস্থলে। সংশ্লিষ্ট একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র থেকে ঘটনার সত্যতা মিললেও নারী ঘটিত অনৈতিক কর্মকাণ্ডসহ সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ওই ওসি।
পাউবো, পুলিশ ও একাধিক সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে তথ্য মিলেছে, ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর থানার অফিসার ইনচার্জ মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম গত ৩০ জুন রাতে স্ত্রী পরিচয়ে এক নারীকে নিয়ে যশোর পাউবো পুরাতন রেস্ট হাউজে ওঠেন। তিনি ওই ভবনের কপোতাক্ষ নামীয় রুমে সময় কাটচ্ছিলেন। বিষয়টি রাজনৈতিক পরিচয়ধারী ওয়াপদার কিছু লোকজনের নজরে আসে। তারা প্রথমে একজন দুজন করে ও পরে দলবদ্ধ হয়ে রেস্ট হাউজে প্রবেশ করেন। এপর ধাক্কাধাক্কি ও ডাকাডাকি করে ওসিকে দরজা খুলতে বাধ্য করেন। ওই চক্রটি ওসি ও ওই নারীর ভিডিও ধারণ করেন। এমনকি ঘরে দরজা লাগিয়ে সাইফুল ইসলামকে লাঞ্ছিত করেন। এছাড়া ব্লাকমেইল করে ৫ লাখ টাকা দাবি করেন মুক্তি দেয়ার শর্তে। ঘন্টা খানেক দেন দরবার, পরে একটি অংশ নগদ ও পরে বাকি টাকা দেয়ার শর্তে সমঝোতা হয়। ওসিকে অবরুদ্ধ করে রাখার সময় পরিদর্শন বাংলোর কেয়ারটেকার মিজানুর রহমান নুর ও বাবুর্চি মিজানুর রহমান মিজানকেও অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ ও শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হয়।
এদিকে ঘটনার সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ৩০ জুন সন্ধ্যা ৬ টা ১০ মিনিটে মহেশপুর থানার অফিসার ইনচার্জ মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম এক নারীকে সাথে নিয়ে যশোর পাউবোর ভেতরে প্রবেশ করেন। রাত ৭.৪০ মিনিটে একটি রাজনৈতিক দলের সংশ্লিষ্ট দুজন পরিদর্শন বাংলোর চারপাশে ঘোরাঘুরি করছেন ও উঁকিঝুঁকি মারছেন।
এরপর একজন দৌঁড়ে সিসি ক্যামেরা ফ্রেমের বাইরে চলে যান। এর এক মিনিট পর সংঘবব্ধ হয়ে আরো কয়েকজন পরিদর্শন বাংলোয় এসে প্রবেশের চেষ্টা করেন। এরপর কিছুক্ষণ তারা বাংলোর প্রবেশ মুখে অবস্থান নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। বাংলোর দরজা ধাক্কাধাক্কি করতে থাকেন। বাংলোর দরজা না খোলায় রাত ৭.৫৭ মিনিটে তাদের কয়েকজন পাউবোর প্রধান ফটকের সামনে গিয়ে কয়েক মিনিট মোবাইল ফোনে অন্য কারো সাথে কথোপোকথন চালান। প্রায় পাঁচ মিনিটের আলোচনা শেষে চক্রে একজন ফের ভেতরে প্রবেশ করে বাংলোর সামনে হৈ হুল্লোড় করতে থাকেন। একপর্যায়ে বাংলোর ভেতরে অবস্থানরত ওসি সাইফুল দরজা খুলতে বাধ্য হন এবং দরজা খুলেই তিনি স্থান ত্যাগ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু চক্রের লোকজন সাইফুল ইসলামকে টেনে হেঁচড়ে বাংলোর ভেতরে নিয়ে যান এবং দরজা বন্ধ করে দেন।
রেস্ট হাউজে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা চলছে খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যাওয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের কয়েকজন স্টাফ জানান, সংঘবদ্ধ চক্রের লোকজন বাংলোর ভেতরে প্রবেশের পর ওসি ও এক নারীকে ঘরে আটকে রেখে দরজা আটকে দেন এবং ভেতরে কাউকে প্রবেশ করতে দেননি। ওই সময় ঘরের ভেতর থেকে ভাংচুর ও মারপিটের শব্দ শুনতে পান তারা। পরে ভেতরে প্রবেশের পর দেখতে পান বাংলোর টি টেবিলের উপরের গ্লাস ভেঙে পড়ে আছে।
এ ব্যাপারে ওই সময় গেটে ডিউটি করা দায়িত্বরত আনসার সদস্য রাজুর কাছে ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, এক ব্যক্তি ওই দিন সন্ধ্যায় একজন নারীকে সাথে নিয়ে বাংলোতে প্রবেশ করেন। এর ঘন্টাখানেক পরে এলাকার কিছু লোকজন বাংলোর ভেতরে প্রবেশের পর দরজা আটকে দেন এবং ভেতরে কাউকে প্রবেশ করতে দেননি। এরপর আরো অনেকে আসেন, থানা থেকে পুলিশের লোকজন আসেন। তার ডিউটি শুধু প্রধান গেটে। প্রকৃত ঘটনা কি ছিল তা রেস্ট হাউজের দায়িত্বশীলরা ভাল বলতে পারবেন।
এ বিষয়ে রেস্ট হাউজের ইনচার্জ সাব অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার তরুন হোসেন জানিয়েছেন, কার্যত পানি উন্নয়ন বোর্ড যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলীর নির্দেশনায় তিনি ওসি সাইফুল ইসলামকে কক্ষ বরাদ্দ দিয়েছিলেন। সাথে আনা নারীকে স্ত্রী পরিচয় দিয়েছিলেন। আর সাইফুল ইসলাম রেস্ট হাউজে অবস্থান কালেই অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটে। এ খবরে পাউবো ও থানার লোকজন সেখানে যান। এ ব্যাপারে আরো ভাল বলতে পারবেন নির্বাহী প্রকৌশলী।
ঘটনার ব্যাপারে নির্বাহী প্রকৌশলী পলাশ কুমার ব্যানার্জী ফোন রিসিভ না করায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। অবশ্য খোঁজ নিয়ে জানা গেছে তিনি ১ জুলাই থেকে ঢাকায় অবস্থান করছেন।
ঘটনার ব্যাপারে পাউবো রেস্ট হাউজের কেয়ারটেকার মিজানুর রহমান নুরু জানিয়েছেন হ্যাঁ ঘটনা সত্য। ওসি সাইফুল স্যার ৩০ জুন সন্ধ্যায় নিজের স্ত্রী পরিচয়ে একজন নারীকে নিয়ে বাংলোয় ওঠেন। তিনি নিজে দরজা খুলে দেন। এছাড়া কপোতাক্ষ গুছিয়ে দিয়ে বুঝিয়ে দিয়ে যান। এরপর কিছু সময় পর ওসি স্যার নাস্তা আনতে তাকে শহরের একটি হোটেলে পাঠান। আর সাইফুল ইসলাম ওই নারীসহ কক্ষে ঘন্টা খানেক অবস্থান করার পরে এলাকার কিছু উচ্ছৃঙ্খল লোকজন প্রবেশ করেন। রেস্ট হাউজের সামনে এসে দরজা ধাক্কাধাক্কি করেন। এর কিছুক্ষণ পর সাইফুল ইসলাম দরজা খুলে বের হেয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। আর চক্রটি তাকে টেনে হিঁচড়ে ওই নারীসহ ঘরে ঢোকায়। এ সময় সাইফুল ইসলাম টাকা বের করে দেন চক্রের লোকজনের হাতে। টাকা লেনদেন তিনি দেখে ফেলায় এবং রেস্ট হাউজে অবস্থান করার চেষ্টা করায় তাকেও মারপিট করেন। বাবুর্চি মিজানকেও মারপিট করে চক্রটি। এরপর পুলিশ আসে, পাউবোর সিনিয়র কর্মকর্তারা আসেন। উত্তেজনা কমে যায়। এরপর ওই চক্রের সাথেই বের হয় যান সাইফুল ইসলাম ও ওই নারী।
ঘটনার ব্যাপারে অভিযুক্ত মহেশপুর থানার অফিসার ইনচার্জ সাইফুল ইসলাম জানান, ওই নারী তার স্ত্রী নন সত্য। তবে তার বন্ধু ছিলেন। রেস্ট হাউজে অনৈতিক কর্মকান্ডের যে অভিযোগ করা হচ্ছে তা সত্য নয়। সেখানে আপত্তিকর কিছু হয়নি। এলাকার যারা তার কক্ষে প্রবেশ করেছিল বলে বলা হচ্ছে, তারা খারাপ উদ্দেশ্যে নয়, তারা তার পূর্ব পরিচিত ছিল।
এদিকে অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, ওই নারীর সাথে সাইফুল ইসলামের অনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। এর আগেও তিনি ওই নারীকে নিয়ে ওই বাংলোয় এসেছিলেন। আর ৩০ জুনের ঘটনা ঝিনাইদহ পুলিশ সুপার, যশোর পুলিশ সুপারসহ যশোর ও ঝিনাইদহ পুলিশের আরো কয়েক উর্ধŸতনের নলেজে রয়েছে। এ ব্যাপারে গোপনে ডিএসবির তদন্তও চলছে।
এ বিষয়ে ঝিনাইদহের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মনজুর মোর্শেদ জানিয়েছেন, এ ধরনের কোনো ঘটনার বিষয়ে তিনি জানেননা। তবে অভিযোগ আসলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে। একই কথা বলেন ঝিনাইদহ জেলা পুলিশের মিডিয়া মুখপাত্র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইমরান জাকারিয়া। তিনি জানান, এ ব্যাপারে অভিযোগ আসলে তদন্ত করা হবে।
এদিকে যশোর কোতোয়ালি থানার ইন্সপেক্টর তদন্ত কাজী বাবুল হোসেন জানিয়েছেন, পাউবো রেস্ট হাউজে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটেছে হট্টগোল হচ্ছে এমন সংবাদে ওই দিন রাতে হামিদুর রহমান নামে একজন অফিসারকে সেখানে পাঠান তিনি। ওই অফিসার ফিরে এসে জানান মিমাংসা হয়ে গেছে, কারো কোনো অভিযোগ নেই।
এ ব্যাপারে ঘটনাস্থলে যাওয়া এসআই হামিদুর রহমান জানান ঘটনাস্থলে যাওয়ার পর সেখানে কোনো ঝামেলা চোখে পড়েনি। সেখান থেকে জানানো হয় কোনো সমস্যা নেই। আর যাকে ঘিরে অভিযোগ ও যারা ফোন করেছিল কেউ কোনো অভিযোগ না করায় তিনি চলে আসেন থানায়।