বাংলার ভোর প্রতিবেদক
যশোর পিটিআই’র চলমান ব্যাচের ১৫০ প্রশিক্ষার্থীর মাসিক ভাতা থেকে ২০০ টাকা করে কর্তনের অভিযোগ উঠেছে সুপারিনটেনডেন্ট আতিয়ার রহমানের বিরুদ্ধে। ‘এজি অফিস ম্যানেজ’ করার নামে এই টাকা কর্তন করা হয়েছে। একই সাথে প্রশিক্ষার্থীদের প্রতিষ্ঠানিক পোশাক (ইউনিফর্ম) নির্দিষ্ট দোকান থেকে কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে। ওই সব দোকান থেকে বড় অংকের টাকা কমিশন নিচ্ছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
এসব অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযেগে সুপারিনটেনডেন্ট আতিয়ার রহমানের অপসারণ দাবিতে সোমবার বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন করেছে প্রশিক্ষার্থীরা। পিটিআই ক্যাম্পাসে বেলা সাড়ে ১১ টার দিকে এই কর্মসূচি পালিত হয়। এর আগে রোববার বেলা ১১টা থেকে প্রশিক্ষার্থীরা অনির্দিষ্টকালের জন্যে কাস বর্জন শুরু করেন। তারা জানিয়েছেন, যতদিন এই দুর্নীতিবাজ সুপারিনটেনডেন্ট দায়িত্বপালন করবেন, ততদিন তারা আর ক্লাসে ফিরবো না।
সোমবার সকালে পিটিআই ক্যাম্পাসে গিয়ে দেখা গেছে, প্রশিক্ষণার্থীরা ক্লাস বর্জন করে শ্রেণীকক্ষের বাইরে অবস্থান করছেন। প্রশিক্ষণার্থীদের ক্লাস বর্জনের খবর পেয়ে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা প্রশিক্ষণার্থীদের বক্তব্য শুনতে পিটিআই ক্যাম্পাসে যান। সেখান থেকে তিনি সবাইকে ক্লাসরুমে যান। কিন্তু সেখানে আন্দোলনরত প্রশিক্ষণার্থীদের তিনি বলেন আপনারা ক্লাস শুরু করেন। বিষয়টি আমরা দেখছি। কিন্তু আন্দোলনের দুইদিন পার হলেও তিনি ব্যবস্থা না দেয়াতে প্রশিক্ষণার্থীদের তোপের মুখে পড়ে পিটিআই ক্যাম্পাস ত্যাগ করেন। একই সাথে তিনি লিখিত অভিযোগ দেয়ার জন্যে তিনি সবাইকে বলে আসেন।
২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের প্রশিক্ষণার্থী আবু জাফর গিফারি বলেন, সুপারিনটেনডেন্ট আতিয়ার রহমানের দায়িত্ব পালন কালে আমরা কিছু শিখতে চাই না। তিনি দুর্নীতিগ্রস্ত। আমরা তো মানুষ গড়ার কারিগর। আমরা এখানে এসেছি শিক্ষকদের আরো প্রশিক্ষণ নিচে। সেই কারিগররা দুর্নীতিবাজদের কাছে এসে কি শিখবে। এই সুপারিনটেনডেন্টের কাছে দুর্নীতি ছাড়া কিছুই শিখতে পারবো না। তাই তার অপসারণ চাচ্ছি। তিনি বলেন, ক্লাস বর্জনের খবরে গতকালও জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার এসেছিলেন। তিনি আমাদের আশ্বাস্ত করেছিলেন আজ সোমবার সুপারিনটেনডেন্টের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবেন। তিনি আজও এসে কোন ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানাননি। ফলে আমাদের কর্মসূচি চলবে।
প্রশিক্ষণার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পোশাগত মান উন্নয়নের জন্যে ১০ মাসের প্রশিক্ষণ কোর্স চলমান রয়েছে। এই কোর্সের জন্যে ছয় মাস আবাসিক ও চার মাস অনাবাসিক প্রশিক্ষণ গ্রহণের নিয়ম রয়েছে। ১৫০ জন করে প্রতি ব্যাচে প্রশিক্ষণ নেন। শুরুতে প্রাতিষ্ঠানিক পোশাকের মধ্যে নারীদের শাড়ি ও পুরুষদের শার্ট-প্যান্ট এবং সকালে প্যারেডের জন্যে নারী-পুরুষ উভয়কেই জুতা-টি শার্ট-ট্রাউজার কিনতে হয়। এসব পোশাক কেনার জন্যে সরকার জনপ্রতি দুই হাজার টাকা দিলেও পাঁচ হাজারের বেশি টাকা প্রশিক্ষণার্থীদের খরচ হয়। প্রশিক্ষণার্থীরা অভিযোগ করে বলেন, ওই পোশাকের দাম যাচাই করে নিজেদের ইচ্ছামত দোকান থেকে কেনার সুযোগ নেই।
পিটিআই সুপারিনটেনডেন্ট আতিয়ারের নিজের পছন্দের ব্যক্তি ও দোকান থেকে এসব পোশাক কিনতে বাধ্য করেন। এসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান থেকে পিটিআই সুপার কমিশন নেন। এ বিষয়ে অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, যশোর কালেক্টরেট মার্কেটের বলাকা টেইলার্স থেকে পুরুষদের শার্ট প্যান্ট ও মেয়েদের শাড়ি নিতে বাধ্য করা হয়। এই প্রতিষ্ঠান থেকে পুরুষদের শার্ট ও প্যান্ট প্রতি ১০০ টাকা করে কমিশন নেন অতিয়ার। এছাড়া নারী ও পুরুষদের অন্যান্য পোষাকের ক্ষেত্রে ৩০০ টাকা করে ওইসব প্রতিষ্ঠান থেকে কমিশন তোলেন তিনি।
কমিশনের টাকা দেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বলাকা টেইলার্সের সত্ত্বাধিকারী এনামুল কবির বলেন, ‘মিষ্টি খাওয়ার জন্যে পুরুষদের শার্ট-প্যান্ট প্রতি পিটিআই সুপারিনটেনডেন্ট আতিয়ার রহমানকে ১০০ টাকা করে দিতে হয়’। পাঁচ বছর ধরে তিনি পিটিআই প্রশিক্ষণার্থীদের পোশাক তৈরি করে দিচ্ছেন বলে জানান তিনি। সুপারিনটেনডেন্ট আতিয়ার রহমান যশোর পিটিআইতে চার বছর ধরে দায়িত্ব পালন করছেন।
এজি অফিস ম্যানেজের নামে ২০০ টাকা করে কর্তনপ্রশিক্ষণার্থীরা মাসিক তিন হাজার টাকা করে সরকারি ভাতা পান। চলতি মাসের টাকা পরের মাসে দেয়া হয়। কিন্তু জেলা অ্যাকাউন্স অ্যান্ড ফাইন্যান্স অফিস ম্যানেজ করার কথা বলে প্রত্যেক প্রশিক্ষণার্থীর কাছ থেকে ২০০ টাকা করে কেটে নেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সুপারিনটেনডেন্ট আতিয়ার ক্যাম্পাসে উপস্থিত সাংবাদিকদের কিছু বলেননি। তবে পরে সাংবাদিকদের বলেন, ‘চ্যানেলে ঘুসের টাকা না দিলে এজি অফিস (জেলা অ্যাকাউন্স অ্যান্ড ফাইন্যান্স) থেকে কোনো বিল পাশ করে না। ২০০ টাকা করে প্রশিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নিয়ে এজি অফিসে ঘুষ দিতে হয়েছে’।
এই অভিযেগের বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা অ্যাকাউন্টন্স অ্যান্ড ফাইন্যান্স কর্মকর্তা মোখলেছুর রহমান বলেন, ‘ঘুষ নেয়ার অভিযোগ ঠিক না। বিল আনলে পাশ করে দিই’। সংস্থাপন চার্জ নিয়ে আপত্তি আবাসিক হলে থাকার জন্যে প্রত্যেক প্রশিক্ষণার্থীর কাছ থেকে মাসে ৫০০ টাকা করে সংস্থাপন চার্জ নেয়া হয়। আবাসিক হলে না থাকলেও এই চার্জ বাধ্যতামূলকভাবে দিতে হয়। ব্যাচ প্রতি মাসে ৭৫ হাজার টাকা করে ওঠে। দুইটি আবাসিক হলের আয়ার বেতন ও পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার জন্যে এই টাকা তোলা হয়। অথচ এই টাকা গ্রহণের কোনো রশিদ দেয়া হয় না। প্রশিক্ষণার্থীরা বলেন, ‘সংস্থাপন চার্জ নেয়ার বিষয়ে কোনো প্রজ্ঞাপন আছে কিনা তা আমাদের জানা নেই। রশিদ ছাড়াই প্রতি মাসে ৫০০ টাকা করে এই চার্জ নেয়া হয়। প্রতি মাসে ৭৫ হাজার টাকা ওঠে। যা খরচ হওয়ার কথা না।
আবাসিক হলের স্থায়ী অবকাঠামো উন্নয়নেও এই টাকা খরচ করা হচ্ছে’। এ বিষয়ে সুপারিনটেনডেন্ট আতিয়ার রহমান বলেন, ‘সংস্থাপন চার্জের টাকা প্রশিক্ষার্থীরা উত্তোলন করে। আবার তাদের মাধ্যমেই খরচ হয়। হোস্টল সুপারেরা বিষয়টি দেখেন। এখানে আমার কোনো ইনভলমেন্ট নেই’।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক আবরাউল হাছান মজুমদার বলেন, ‘বিষয়টি শুনে আমি জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে সেখানে পাঠিয়েছিলাম। তিনি বিষয়টা দেখছেন’। আর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আশরাফুল আলম বলেন, ‘আমি পিটিআই ক্যাম্পাসে গিয়ে প্রশিক্ষার্থীদের অভিযোগগুলো শুনেছি। তাদেরকে লিখিত অভিযোগ দিতে বলেছি। লিখিত অভিযোগ পেলে শিক্ষা সচিব ও অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে পাঠিয়ে দিবো’।