রুদ্র নীল
যশোর অঞ্চলে সোনা চোরাচালান কোনোভাবে বন্ধ করা যাচ্ছে না। সীমান্তরক্ষী বাহিনী অর্থাৎ বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি) প্রতিনিয়ত স্বর্ণের চোরাচালান জব্দ করছে। গেল বছরের ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে যশোরের বিভিন্ন চোরাচালানী রুট দিয়ে সোনা চোরাচালান বেড়েছে। সূত্র বলছে, নির্বাচন সামনে রেখে ভারত থেকে স্বর্ণের বিনিময়ে মাদক ও অস্ত্র আমদানি করছে এই অঞ্চলের কয়েকটি চক্র। স্বর্ণের বারকে অস্ত্র ও মাদকের বড় বড় চালানের মূল্য পরিশোধের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। গত ১৬ মাসের সোনা চোরাচালানের রেকর্ড বলছে, রাজধানী ঢাকার ধোলাইপাড়সহ বিভিন্ন এলাকা থেকে স্বর্ণের চালান আসে যশোর রুটে। ফরিদপুরের রাজবাড়ি, যশোরের মোল্ল্যাপাড়া ও সাতক্ষীরা এলাকার চোরাকারবারিরা এই স্বর্ণ বহন করে থাকে। এবং একই রুটে কয়েকবার হাত বদল হয়ে স্বর্ণ চলে যায় ভারতে।

বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি) যশোর ৪৯ ব্যাটালিয়ন সুত্রে জানা গেছে, গত বছরের ৫ আগস্ট থেকে ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত যশোরে চোরাই স্বর্ণ জব্দ করা হয়েছে ৩১ কেজি ৪৩০ দশমিক ১৩ গ্রাম। যার অনুমানিক বাজার মূল্য ৪৪ কোটি ৯০ লাখ ১৭ হাজার ৬৩৮ টাকা। এই ১৬ মাসে স্বর্ণ চোরাচালানের সময় স্বর্ণের বারসহ আটক হয়েছে ৩৩ জন। মামলা হয়েছে সর্বমোট ২৯ টি।

কেন পাচার হচ্ছে স্বর্ণ এমন প্রশ্নের উত্তরে আমরা সীমান্তবর্তী এলাকার কয়েকজনের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছি। তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমাদের জানিয়েছেন, অনেক সময় স্বর্ণ যার মাধ্যমে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নেয়া হয় তখন স্বল্প দূরত্বের ক্ষেত্রে যার মাধ্যমে স্থান পরিবর্তন করা হয় সে নাও জানতে পারে। আবার অনেক ক্ষেত্রে জেনে বুঝে কাঁচা টাকার নেশায় স্বর্ণ বহন করে থাকে পাচারকারিরা। এক্ষেত্রে প্রতি ১০ গ্রামে দুই থেকে ৫ হাজার টাকা বহনকারী পেয়ে থাকে।

এবং সাধারণত মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বহনকারীর শ্রম মূল্য অগ্রিম পরিশোধ করা হয়। তাই মূল ব্যবসায়ী এক্ষেত্রে ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। বহনকারি আটক হলে তার নামে মামলা হয়। স্বর্ণ চোরাচালান গ্রুপের মধ্যে মনোমালিন্য বা তথ্য দেয়ার মাধ্যমে অর্থ পাওয়ার জন্য নিজেরা নিজেরা একে অন্যের স্বর্ণ প্রশাসনের কাছে ধরিয়ে দিয়ে থাকে। নিরাপদে সোনার চালান এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য পাচারকারিরা অস্ত্রও বহন করে। এমনকি স্বর্ণসহ বহন কারিকে অন্য গাড়িতে দিয়ে শেল্টারদাতারা অস্ত্রসহ অন্য গাড়ি নিয়ে অনুসরণ করে। এক্ষেত্রে ব্যক্তিগত মাইক্রো ও মোটরসাইকেল বেশি ব্যবহৃত হয়।

চলতি বছরের ২৬ জুন ভোর আনুমানিক ৪টার দিকে যশোর-বেনাপোল মহাসড়কের নতুনহাট এলাকায় একটা চাঞ্চল্যকর সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। যশোর শহর থেকে বেনাপোলের দিকে যাওয়ার সময় একটি প্রাইভেটকার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন এবং রাস্তার পাশে থাকা একটি গাছে সজোরে ধাক্কা খায়। গাড়িটি দুমড়েমুচড়ে যায় এবং ঘটনাস্থলেই দুজনের মৃত্যু হয়।

সেই রাতে ঘটনাস্থলে মারা যায়, যশোর জেলা ছাত্রলীগের সাবেক ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক মাসুদুর রহমান মিলন (৪০) ও শহরের মধুগ্রাম এলাকার লিটন গাজীর স্ত্রী জুঁই আক্তার (৩০)। এই ঘটনায় গুরুতর আহত হন, বাগেরহাটের বাসিন্দা মামুন হোসেন (৩২) ও যশোর সদর উপজেলার বাসিন্দা মাসুদ হোসেন (৪৫)। কথিত রয়েছে এই দুর্ঘটনাটি ছিল পূবপরিকল্পিত। যদিও প্রশাসন এখনও পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট কারণ উদঘাটনে তদন্ত করছেন। সূত্র মতে সেদিন স্বর্ণের চালান বেনাপোল হয়ে ভারতে যাওয়ার পথে এই দুর্ঘটনা ঘটে। একটি পক্ষের দাবি দুর্ঘটনার সময় ওই গাড়িতে থাকা স্বর্ণ লুট করে প্রতিপক্ষ। সূত্র মতে দুর্ঘটনার রাতে শহরের ্কিেট অভিযাত হোটেলে ব্যস্ত সময় পার করে জুই-মাসুদ। এবং মধ্য রাতে তাদেরকে শহরের বিভিন্ন স্থানে ঘোরাঘুরি করতেও দেখা যায়। পরে ভোরে সংঘটিত হয় ওই দুর্ঘটনা যাতে প্রাণ হারান দু’জনই। ওই দুর্ঘটনায় আহত যশোর সদর উপজেলার বাসিন্দা মাসুদ হোসেনের নামে এর আগেও স্বর্ণ চোরাচালানের একাধিক রেকর্ড পাওয়া গেছে।

স্বর্ণের সাথে অস্ত্রের লিংকের কথা সূত্র বললেও গত ৩০ ডিসেম্বর ৫টি আধুনিক পিস্তলসহ গভীর রাতে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত জুঁইয়ের স্বামী লিটন গাজীকে আটকের পর বিষয়টি আবারো আলোচনায় উঠে আসে। সূত্রের খবর যাচাই বাছাইয়ের পর জানা যায় নিরাপদে স্বর্ণ পাচারের জন্য আগ্নেয়াস্ত্র বহন ও স্বর্ণের বিনিময়ে অস্ত্র আমদানির কথা।

৪৯ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল সাইফল্লাহ সিদ্দিকীর সাথে এ বিষয়ে কথা হলে তিনি এই প্রতিবেদককে জানান, স্বর্ণের বিনিময়ে ভারত থেকে অস্ত্র ও মাদকের চালান আসছে এমন কোনা তথ্য তাদের কাছে নাই। তাদের গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত রয়েছে।

বাংলাদেশ থেকে স্বর্ণ কেন পাচার হয় এমন প্রশ্নের উত্তরে সাইফুল্লাহ সিদ্দিকী জানান, বিদেশ থেকে দেশে আসা যাত্রীদের বড় অংশ কর ফাঁকি দিয়ে থাকে। সে কারণে চোরাই পথে স্বর্ণ বাংলাদেশে আসে। আর আমাদের এয়ারপোর্টগুলো দিয়ে স্বর্ণ চোরাচালান করা হয়ত সহজ তাই ট্রানজিট হিসেবে বাংলাদেশকে ব্যবহার করে থাকে চোরাকারবারিরা।

যশোর অঞ্চলে স্বর্ণ চোরা কারবার ও বহনকারি বেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি জানান, যশোর সীমান্তবর্তী জেলা। এই অঞ্চলের লোকজন সীমান্তবর্তী এলাকার রাস্তা-ঘাট সহজে চেনে। যার ফলে এই অঞ্চলের মানুষ ১০ থেকে ২০ হাজার টাকার বিনিময়ে বহনকারি হিসেবে কাজ করে থাকে।

Share.
Leave A Reply Cancel Reply
Exit mobile version