বাংলার ভোর প্রতিবেদক
আজ সোমবার ৪ নভেম্বর দেশের রাজনীতির অন্যতম প্রবাদপুরুষ, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উন্নয়নের কারিগর খ্যাত বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক মন্ত্রী তরিকুল ইসলামের সপ্তম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০১৮ সালের আজকের দিনে ঢাকায় অ্যাপোলো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দেশবাসীকে কাঁদিয়ে চিরবিদায় নেন জনপ্রিয় এ রাজনীতিক। মৃত্যুকালে তিনি ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের অসংখ্য গায়েবি মামলায় অভিযুক্ত ছিলেন। এ জননেতার মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে গত শনিবার থেকে নানা কর্মসূচিতে পালিত হচ্ছে। আগামী ৬ নভেম্বর ৩ টায় যশোর টাউন হল ময়দানে অনুষ্ঠিত হবে স্মরণ সমাবেশ। সমাবেশে প্রধান অতিথি থাকবেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফকরুল ইসলাম আলমগীরসহ কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ।
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের রাজনীতির কথা উঠলেই যার নাম সর্বাগ্রে স্মরণে আসে তিনি তরিকুল ইসলাম। বিএনপির রাজনীতির পুরোধা ব্যক্তিত্ব। সফল রাজনীতিক ও জনপ্রিয় জনপ্রতিনিধি দুইয়ের সাফল্যে তিনি হয়ে ওঠেন এ অঞ্চলের জনমানুষের জননেতা। তাঁকে ভোট দিয়ে অথবা বিএনপি সরকার গঠন করলে কখনও বঞ্চিত হয়নি যশোরের মানুষ। কেননা জন্মভূমি যশোরকে নিয়ে তিনি নিজেই স্বপ্ন দেখতেন এবং স্বপ্ন দেখাতেন। তাই না চাইতেই যশোরবাসী পৌঁছেছেন উন্নয়নের শিখরে। দলমত নির্বিশেষে এ জেলার মানুষ এ কারণে বারংবার তাঁকে স্মরণ করেন। উন্নয়নের কথা উঠলেই প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন তরিকুল ইসলাম। তাইতো তাঁর চিরবিদায়ে ২০১৮ সালের ৫ নভেম্বর যশোর ঈদগাহ রূপ নিয়েছিল জনসমুদ্রে। জননেতার চিরপ্রস্থান ঘটেছিল গণজোয়ারে।
যশোরবাসীর চাওয়া ছিল একটি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ। এ চাওয়া পূরণ করেছেন তরিকুল ইসলাম। তার হাতের ছোঁয়ায় যশোরসহ এ অঞ্চলের রাস্তা-ঘাট, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা, মসজিদ-মন্দিরের অবয়বে এসেছে পরিবর্তন। আজও সে উন্নয়ন মানুষকে নাড়া দেয়। যশোরের ১০০ শয্যার হাসাপাতালকে ২৫০ শয্যা হাসপাতালে উন্নীত এবং একটি আধুনিক করোনারি কেয়ার ইউনিট স্থাপন করেন। বেনাপোল ও নওয়াপাড়া পৌরসভা এবং যশোর রেলওয়ে স্টেশনের উন্নয়ন তার হাত দিয়েই হয়েছে। যশোর আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস, কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, যশোর কালেক্টরেটের বিশাল দ্বিতল ভবন, জজ কোর্ট, আইনজীবী ভবন, সার্কিট হাউসের নতুন ভবন, এলজিইডি ভবন, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, যশোর শিক্ষা বোর্ড স্কুল ও কলেজ, যশোর সরকারি এমএম কলেজের বর্ধিত ভবন ও খালেদা জিয়া ছাত্রীনিবাস, সিটি কলেজের ছাত্রবাস, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের আঞ্চলিক কেন্দ্র, শিক্ষা বোর্ডের বহুতল ভবন, সরকারি শিশু পরিবার (বালিকা), শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র (বালক), গণগ্রন্থাগার ছাড়াও অসংখ্য উন্নয়ন রয়েছে তাঁর।
জননেতা হয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতিহিংসার শিকার হয়েছেন তরিকুল ইসলাম। নির্মম নানান ষড়যন্ত্রের শিকার হতে হয়েছে তাঁকে।
১/১১-এর পর মঈন-ফখরুদ্দিনের অদ্ভুত তত্ত্ববধায়ক সরকার ও তাদের সহায়তায় ২০০৯ সালে ক্ষমতায় বসা ২০২৪ সাল পর্যন্ত শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনামলের প্রধান রাজনৈতিক টার্গেটে পরিণত হন তরিকুল ইসলাম ও তাঁর পরিবার। এ সময় তিনি মিথ্যা মামলায় কয়েক দফা কারাবাস করতে বাধ্য হন। তাঁর পরিবারের একটি মাত্র শিশু বাদে সকল সদস্য একের পর এক মিথ্যা মামলার আসামি হন। স্বৈর ও ফ্যাসিস্ট শাসকরা তাঁর পরিবারের উন্নয়নের অবদান মুছে ফেলার চেষ্টার পাশাপাশি অসততার কলঙ্কে কলুষিত করার চেষ্টা করে। তরিকুল ইসলাম ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা সকল মিথ্যা মামলায় আদালতের রায়ে নির্দোষ প্রামাণিত হন।
তরিকুল ইসলাম রাজনীতিক পুরোধা ব্যক্তিত্ব হওয়ার পিছনে ভূমিকা ছিলো তার স্ত্রী অধ্যাপক নার্গিস বেগমের। তাই তো দলও তাকে মূল্যায়ন করেছেন। চলতি বছরের ১৩ মার্চ নার্গিস বেগমকে করা হয় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান। অবর্তমানে যশোর জেলা বিএনপির হাল তার কনিষ্ঠ পুত্র অনিন্দ্য ইসলাম অমিতের হাতে। শুধু যশোর নয়; খুলনা বিভাগীয় বিএনপির দায়িত্ব অমিতের কাঁধে। আর জ্যেষ্ঠ পুত্র শান্তনু ইসলাম সুমিত, তরিকুল ইসলামের প্রতিষ্ঠিত গণমানুষের কণ্ঠস্বর দৈনিক লোকসমাজের প্রকাশক হিসেবে যোগ্যতার সাথে দায়িত্ব পালন করছেন।
১৯৪৬ সালের ১৬ নভেম্বর যশোর শহরে জন্ম তাঁর। পিতা আলহাজ আব্দুল আজিজ ছিলেন একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। মা নূরজাহান বেগম ছিলেন গৃহিণী। ১৯৬১ সালে তিনি যশোর জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন, ১৯৬৩ সালে যশোর মাইকেল মধুসূদন মহাবিদ্যালয় থেকে আইএ পাস করেন। এরপর তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে বিএ (অনার্স) এবং ১৯৬৯ সালে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। তরিকুল ইসলাম ছাত্র ইউনিয়নের মাধ্যমে ছাত্র রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন। ১৯৬৩-৬৪ শিক্ষাবর্ষে তিনি বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের প্রার্থী হিসেবে যশোর মাইকেল মধুসূদন মহাবিদ্যালয় ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৬৩ সালে সর্বক্ষেত্রে রাষ্ট্রভাষা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে যুগ্ম-আহ্বায়ক ছিলেন। ১৯৬৬ সালে যশোর এম এম কলেজে শহীদ মিনার নির্মাণের সময় প্রথম রাজনৈতিক মামলায় আটক হন এবং কারা নির্যাতন ভোগ করেন। ১৯৬৮ সালে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের জন্যে তাকে রাজবন্দি হিসেবে ৯ মাস যশোর ও রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক রাখা হয়।
১৯৭০ সালে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে যোগ দেন তরিকুল ইসলাম। ১৯৭৩ সালে তরিকুল ইসলাম যশোর পৌরসভার ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৭৪ সালে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী আহূত ফারাক্কা লং মার্চে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন । ১৯৭৫ সালে তিনি বাকশালের বিরোধীতা করে তিন মাস কারাভোগ করেন। ১৯৭৮ সালে তিনি যশোর পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এরপর তিনি বিএনপিতে যোগ দেন এবং যশোর জেলা শাখার প্রতিষ্ঠাকালীন আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৯ সালে যশোর-৩ ( সদর) আসনে বিপুল ভোটে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান শাহাদৎ বরণের পর তিনি বিচারপতি আব্দুস সাত্তারে মন্ত্রীসভায় প্রতিমন্ত্রী নিযুক্ত হন। এরপর স্বৈরাচার এরশাদ রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে সামরিক শাসন জারির পর তরিকুল ইসলামকে গ্রেফতার করেন। প্রথমে তাকে এরশাদের দলে যোগদানের প্রস্তাব দেওয়া হয়। তিনি প্রচন্ড সাহসিকতায় সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে জিয়ার আদর্শে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে দলের সাথে থাকার ঘোষণা দেন। এরপর এরশাদের বিশেষ বাহিনী তরিকুল ইসলামসহ তার বিশ্বস্ত বেশ কিছু শীর্ষ নেতার এরশাদ হত্যা ষড়যন্ত্রের মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে গুম করেন। দীর্ঘ কয়েক মাস তাঁর কোন সন্ধান না পাওয়ার পর পরিবারের পক্ষ থেকে ভয়েজ অব আমেরিকার তৎকালীন প্রখ্যাত সাংবাদিক গিয়াস কামাল চৌধুরীর স্মরণাপন্ন হন। তিনি একটি শক্তিশালী রিপোর্ট করার পর স্বৈরশাসক তরিকুল ইসলামসহ আটক নেতৃবৃন্দকে কারাগারে প্রেরণ করে। গুম থাকাকালে তরিকুল ইসলামের ওপর নজীরবিহীন পৈশাচিক নির্যাতন চালানো হয়। নির্যাতকরা প্লায়ার্স দিয়ে একটার পর একটা দাঁত উপড়ে ফেলে এবং তাঁর কণ্ঠ স্তব্ধ করে দিতে গলায় ইলেট্রিক শক দেয়। এই নির্মম নির্যাতনের কারণে তিনি ডায়াবেটিস, কিডনি ও হৃদরোগসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হন। পরবর্তীতে তিনি জামিন লাভ করে আবারও বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় হন এবং মৃত্যুর মুহূর্ত পর্যন্ত দলের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। পরে খালেদা জিয়ার সরকারের মন্ত্রী হয়ে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সততার সাথে ব্যাপক কর্মযজ্ঞের নজীর গড়েন।
১৯৮৬ সালে তিনি বিএনপির যুগ্ম মহাসচিবের দায়িত্ব পান। এ সময়ে তিনি এরশাদ বিরোধী দুর্বার আন্দোলনে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯০’র গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তরিকুল ইসলামের অগ্রণী ভূমিকা ছিল দেশব্যাপি আলোচিত বিষয়। ১৯৯১ সাল থেকে বিএনপির রাষ্ট্র পরিচালনায় মন্ত্রীর দায়িত্বপালনকালীন তিনি পর্যায়ক্রমে সমাজকল্যাণ ও মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয়, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০১ সালে তিনি লক্ষাধিক ভোটের ব্যবধানে এমপি নির্বাচিত হয়ে প্রথমে খাদ্য ও পরে তথ্য এবং সর্বশেষ বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ছিলেন স্পষ্টভাষী ও জনদরদী রাজনীতিক। আমৃত্যু তিনি বিএনপি জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন।
সপ্তম মৃত্যুবার্ষিকীতে কর্মসূচি
মঙ্গলবার সকাল ৯ টায় জেলা বিএনপির আয়োজনে শহরের কারবালা কবরস্থানে বরেণ্য রাজনীতিক তরিকুল ইসলামের কবর জিয়ারতের মধ্য দিয়ে দিনের কর্মসূচি শুরু হবে। এরপর সকাল ১০ টায় জেলা বিএনপির আয়োজনে দলীয় কার্যালয়ে দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে। সকাল ৮ টায় জেলা শ্রমিকদলের উদ্যেগে জেলা বিএনপি কার্যালয়ের সামনে শ্রমজীবী মানুষের মাঝে খাবার বিতরন করা হবে। বেলা ১২ টায় জেলা বিএনপি কার্যালয়ের সামনে জেলা ছাত্রদলের আয়োজনে স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচি পালিত হবে। রক্তদান শেষে ছাত্রদলের উদ্যোগে যশোরের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি এবং বাদ জোহরবাদ দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে। বেলা সাড়ে ১২ টায় জেলা মৎস্যজীবী দলের উদ্যেগে জেলা বিএনপি কার্যালয়ের সামনে কুরআন শিক্ষার্থীদের মাঝে জায়নামাজ ও টুপি বিতরণ করা হবে। জেলা কৃষকদলের আয়োজনে বিরামপুর হাফেজিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানায় কুরআন খতম ও দোয়া মাহফিল শেষে কুরআন শিক্ষার্থীদের মাঝে খাবার বিতরণ করা হবে। নগর বিএনপির উদ্যোগে যশোর পৌর এলাকার সকল মসজিদে দোয়া মাহফিল হবে। এছাড়া সদর উপজেলা বিএনপির আয়োজনে উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নের সকল মসজিদে দোয়া মাহফিল এবং প্রতিটি গ্রাম, পাড়া, মহল্লায় খাবার প্রদান করা হবে।
আগামী ৫ নভেম্বর (বুধবার) নগর বিএনপির উদ্যোগে শহরের বিভিন্ন এতিমখানায় দোয়া মাহফিল শেষে এতিমদের সম্মানে মধ্যাহ্নভোজ অনুষ্ঠিত হবে। একই দিন সদর উপজেলা বিএনপির আয়োজনে বিভিন্ন এতিমখানায় দোয়া মাহফিল ও এতিমদের সম্মানে মধ্যাহ্নভোজ অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া জেলা যুবদলের আয়োজনে এতিমদের মাঝে খাবার বিতরণ করা হবে। জেলা মহিলাদলের উদ্যোগে দুপুরে এতিমখানায় শিশুদের মাঝে খাবার বিতরণ এবং বাদ আসর যশোর জেলা বিএনপির কার্যালয়ে দোয়া মাহফিল। পরদিন ৬ নভেম্বর (বৃহস্পতিবার) বেলা ৩ টায় টাউন হল ময়দানে জেলা বিএনপির আয়োজনে বরেণ্য রাজনীতিক তরিকুল ইসলামের স্মরণ সভা অনুষ্ঠিত হবে। সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
