# প্রশাসনিক অনুমোদনের অপেক্ষায় কার্যক্রম
# নষ্ট হচ্ছে ২১ কোটি টাকার নতুন ভবন
# মূল্যবান যন্ত্রাংশ চুরি
বাংলার ভোর প্রতিবেদক
১৩ মাস বয়সী আব্দুর রহমান। কোল্ড ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ায় স্বজনেরা যশোরের চৌগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করেন। হাসপাতালের ডায়রিয়া ওয়ার্ডে শয্যা না পাওয়ায় জায়গা হয়েছে বারান্দায়। সেখানে কোন রকম চিকিৎসা চললেও মাঘের হিম শীতল বাতাসে নাজেহাল শিশু ও তার স্বজনেরা। পাশ্ববর্তী উপজেলার ঝিকরগাছার গুলবাগপুর গ্রামের বাড়ি শিশুটির দাদি শাহিদা বেগম বলেন, ‘তিন দিন ধরে পোতা ছেলেডা অসুস্থ। হাসপাতালে নিয়ে এসে বেড পাইনি। বারান্দাতে ডায়রিয়া ওয়ার্ড বানিয়ে ওখানে মেঝেতে চিকিৎসা চলছে। অতিরিক্ত রোগীর চাপে বারান্দায় মেঝেতে গাদাগাদি করে থাকতে হচ্ছে। দিনের বেলায় পাশ দিয়ে মানুষের চলাচলে ধুলা উড়ে আসছে বেডে; অন্যদিকে রাতে শীতের কষ্ট। গরীব মানুষ, উপায় না পেয়ে কষ্ট হলেও থাকতে হচ্ছে এভাবে।’
এই শিশুর মতো হাসপাতালটিতে চিকিৎসা নিতে এসে নানা বয়সী রোগীরা পড়েছেন শয্যা বিড়ম্বনায়। শয্যা সংকটে চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে উপজেলার এই হাসপাতালটিতে। অতিরিক্ত রোগীর চাপে শয্যা না পাওয়ায় কারোও স্থান হয়েছে ওয়ার্ডের মেঝেতে। কারো বারান্দায়। গাদাগাদি করে থাকতে হচ্ছে অনেক রোগীকে। পাশ দিয়ে মানুষ চলাচলের কারণে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে রোগী ও স্বজনদের। পাশাপাশি জায়গা সংকটে বহিঃবিভাগেও চিকিৎসা চলে গাদাগাদির মধ্যেও। ফলে রোগীরা এসে যথাযথ চিকিৎসা সেবা না পাওয়ার অভিযোগও রয়েছে।
অথচ চিকিৎসক ও শয্যা সংকটের কারণে ২০১৮ সালে ৫০ থেকে একশ’ শয্যায় উন্নীত করা হয় হাসপাতালটি। ২১ কোটি ৫৭ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছে ছয় তলাবিশিষ্ট ভবনও। আলাদা ওয়ার্ড, বর্হিবিভাগ, উন্নত ল্যাব, লিফট, আছে নিজস্ব অক্সিজেন প্ল্যান্টের ব্যবস্থাও। রোগীদের উন্নত পয়োঃনিস্কাশনের ব্যবস্থাও। হাসপাতালটির যাবতীয় কাজ শেষ করে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে ঠিকাদার ভবন বুঝিয়ে দিলেও কার্যক্রম শুরু হয়নি। একই সাথে পড়ে রয়েছে চিকিৎসকের দুটি আবাসিক ডরমেটরি ভবনও। এতে উন্নত চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন উপজেলাসহ আশেপাশের কয়েক লক্ষাধিক মানুষ।
সরেজমিনে দেখা গেছে, হাসপাতালের বহিঃবিভাগে দীর্ঘ লাইন। গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে তারা চিকিৎসা নিচ্ছেন। হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডগুলোতেও ভর্তি রোগীর চাপ। বিশেষ করে মহিলা, গাইনি ওয়ার্ড, শিশু ওয়ার্ড, ডায়রিয়া ওয়ার্ডগুলোতে। এসব ওয়ার্ডে মেঝে ও বারান্দাতে মেঝেতে চিকিৎসা নিতে দেখা গেছে।
সিংহঝুলি থেকে আসা নাজমা বেগম বলেন, ‘জায়গা পাইনি, নার্সরা বারান্দাতে জায়গা দিয়েছে সেখানেই চিকিৎসা নিচ্ছি। এই রোগীর স্বজন আলতাফ হোসেন বলেন, ‘হাসপাতালে যখন রোগীর চাপ থাকে তখন চিকিৎসা পেতে নানা সমস্যা দেখা দেয়।’
আহাদ আলী নামে এক রোগীর স্বজন জানান, ‘হাসপাতালে শয্যা সংকট দূরে করতে ১০০শয্যার নতুন হাসপাতাল নির্মাণ করা হয়েছে। অথচ চালু হয়নি। জনগণের দুর্ভোগের কারণেই তো এই হাসপাতাল নির্মাণ; অথচ নির্মাণ হলেও সেই দুর্ভোগ কাটছে না হাসপাতালটি চালুর জন্য।’
পড়ে আছে সাড়ে ২১ কোটি টাকার নতুন ভবন, নষ্ট ও চুরি হচ্ছে মূল্যবান যন্ত্রাংশ:
২১ কোটি ৫৭ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০১৮ সালে ছয় তলা বিশিষ্ট এক শ’ শয্যা হাসপাতাল নির্মাণের কাজ শুরু হয়। ভবন নির্মাণ ও হাসপাতালের ভিতরে যাবতীয় ডেকারেশন শেষ করে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ভবনটি বুঝিয়ে দেন উপজেলা স্বাস্থ ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার কাছে। এর পর হাসপাতালটি চালুর জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে দুই দফা আবেদন জানান উপজেলা স্বাস্থ ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা। দুই দফা দাবি জানিয়েও এখনও পর্যন্ত কোন সাড়া মেলেনি। দীর্ঘদিন ধরে হাসপাতালটি পড়ে থাকাতে নষ্ট হচ্ছে মূল্যবান জিনিসপত্র। নিজস্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকাতে প্রতিনিয়ত চুরি হচ্ছে চিকিৎসা সরঞ্জামও। সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে হাসপাতালের বিভিন্ন তলাতে মূল্যবান জিসিসপত্র খুলে ও কেটে নিয়ে গেছে চোরেরা। বিভিন্ন চিকিৎসা সরঞ্জাম চুরি হওয়ার ঘটনায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও থানায় লিখিত অভিযোগও দিয়েছেন।
হাসপাতালের কয়েকজন কর্মচারী জানান, হাসপাতাল পড়ে থাকাতে ৫০ টার বেশি টয়লেটের বেসিন খুলে নিয়ে গেছে। বিভিন্ন লাইট, অক্সিজেন প্ল্যান্টের পাইপসহ বিভিন্ন মূল্যবান জিনিস।
চিকিৎসক সংকট চরমে:
হাসপাতালে ৩২ জন চিকিৎসকের পদ থাকলেও শূন্য রয়েছে ১৬টি পদ। বাকি ১৬টি পদে চিকিৎসকের নিয়োগ থাকলেও ৩ জন চিকিৎসক ৬ থেকে ১৩ বছর যাবৎ উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই অনুপস্থিত। এছাড়া প্রেষণে আছেন ২ জন চিকিৎসক। ১১ জন চিকিৎসক দিয়ে চিকিৎসা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। তারা ভর্তিরোগী, বহিঃবিভাগে চিকিৎসা দেয়ার পাশাপাশি নাইট ডিউটি, জরুরি বিভাগও সামলাচ্ছেন। এই হাসপাতালে জুনিয়র কনসালটেন্ট (সার্জারি), পেডিয়াট্রিক্স, ইএনটি, অর্থোসার্জারি, কার্ডিওলজি, অফথালমোজি, স্ক্রীন বিষয়ক চিকিৎসকের পদ খালি রয়েছে দীর্ঘদিন।
চৌগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আহসানুল মিজান রুমি বলেন, ‘তিনটি উপজেলার মধ্যেবর্তী স্থানে হাসপাতাল হওয়ায় সব সময় রোগীর চাপ থাকে। রোগীদের শয্যা সংকটের কারণে ৫০ থেকে ১০০ শয্যায় উন্নীতি করলেও সেটি চালু হয়নি দেড় বছরেও। দুই দফা ভবনটি চালুর জন্য লিখিত পত্র পাঠিয়েছি; তবে এখনো সাড়া মেলেনি। এদিকে চিকিৎসক সংকট ও শয্যা সংকটে চিকিৎসা দিতে বেগ পেতে হচ্ছে আমাদের।’