ঝিকরগাছা প্রতিনিধি
বেশ কয়েকদিন ধরে দেশের আরো অনেক জেলার সাথে যশোরের উপর দিয়েও বয়ে চলেছে মৃদ্যু শৈত্যপ্রবাহ। সেই সাথে ঘন কুয়াশায় জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ার পাশাপাশি গাছ গাচালি ও ফসলাদিও পড়েছে হুমকির মুখে। বিশেষ করে দেশের ফুলের রাজধানী খ্যাত ঝিকরগাছার গদখালী অঞ্চলের ফুলচাষিরা পড়েছে মহা দুশ্চিন্তায়। কেননা তীব্র শীত ও ঘন কুয়াশার কারণে ফুল ঝরে যাওয়ার সাথে সাথে মারা যাচ্ছে গাছও।
ফুল চাষি শামিম আহমেদ জানান, চার দিন আগে বৃষ্টি, লাগাতার ঘন কুয়াশা আর প্রচণ্ড শীতে তার বাগানের গোলাপ নষ্ট হয়ে গেছে। বাগানের গাছের কচি পাতা নষ্ট হয়ে ঝরে পড়ছে, গোলাপের কুঁড়িতে পড়েছে কালো দাগ, পাপড়িও ঝরে যাচ্ছে। আগে যেখানে এক বিঘা জমি থেকে দিনে হাজারের মতো গোলাপ তুলেছি, এখন সেখানে একশ’র মতো পাচ্ছি। শুধু গোলাপ নয়, পাতা ঝলসে যাচ্ছে গ্লাডিওলাসের। ঠিকমতো ফুটছে না রজনীগন্ধা। এর ফলে বাজারে গোলাপসহ অন্যান্য ফুলের আমদানি নেই বললেই চলে। কারণ বেশিরভাগ বাগানের ফুল ঝরে যাচ্ছে। এতে লোকসানে পড়তে হবে আমাদের মত চাষিদের।
গদখালীর ফুল বাজারে আসা চাষিরা বলছেন, এবার গোলাপ ফুলে বড় ধরনের লোকসান গুণতে হবে। ফেব্রুয়ারি মাসের প্রধান তিন উৎসব ঘিরে বাগানের পরিচর্যা করেছেন তারা। এরপরও ফুল ঝরে পড়ছে প্রতিদিন। ঝরে পড়ার কারণে চলতি মৌসুমে পাঁচ কোটি টাকার ক্ষতির মুখে পড়তে পারেন তারা।
গত সোমবার গদখালী বাজারে গিয়ে দেখা যায় গোলাপের সংখ্যা কম। কমবেশি সব চাষির মুখে ফুল ঝরে পড়ার কথা। এ নিয়ে কোনও প্রতিকার আছে কিনা, একে-অপরের কাছে জানতে চাইছেন তারা। এদিন গোলাপ ৯-১২ টাকা, গ্লাডিওলাস ৫-১২ টাকা, চন্দ্রমল্লিকা (হলুদ) দুই-আড়াই, চন্দ্রমল্লিকা (সাদা) দেড়-দুই, রজনীগন্ধা ছয়-আট, জারবেরা ১০-১২ টাকা পিস এবং গাঁদা প্রতি হাজার ১০০ টাকা দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে।
চাষি শাওন মোল্যা বাজারে এনেছেন ৫০০ পিস গোলাপ। যার অধিকাংশের পাপড়িতে কালো দাগ দেখা যাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘তিন বিঘা জমি থেকে ৫০০ গোলাপ তুলেছি। বিক্রি করছি ১১ টাকা দরে। দাম বেশি পেলেও জমি হিসেবে সংখ্যা অনেক কম। গত বছর একই বাগান থেকে পাঁচ লাখ টাকার গোলাপ বিক্রি করেছিলাম। এবার অর্ধেকও বিক্রি হয়নি। শীত আর ঘন কুয়াশায় বাগানের ৭০ শতাংশ ফুল ঝরে গেছে। আসছে ভালোবাসা দিবস ও মহান ভাষা দিবসের উৎসবে লাখ টাকার ফুল বিক্রি করতে পারবো বলে মনে হচ্ছে না।
এছাড়া ঘন কুয়াশার কারণে পাতা ঝরে যাচ্ছে, গাছ মরে যাচ্ছে উল্লেখ করে এই চাষি আরও বলেন, ‘ওষুধের দোকানি আর কোম্পানির প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে রোভরাল নামে একটি ওষুধ ব্যবহার করেও কোনও সুফল মেলেনি। গোলাপের সঙ্গে গ্লাডিওলাসেরও ক্ষতি হচ্ছে। এতে বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়তে হবে।
লোকসানের মুখে পড়ার কথা জানিয়ে আরেক চাষি রহমান বলেন, ‘সোমবার গোলাপের পিস ১০-১১ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। গত ডিসেম্বরে পাঁচ টাকায় পিস বিক্রি করেছি। এক বিঘা জমিতে গোলাপ, ১০ কাঠায় গ্লাডিওলাস এবং এক বিঘায় গাঁদা ফুল চাষ করেছি। আবহাওয়ার কারণে গোলাপের উৎপাদন একেবারে কমে গেছে। গাছে পাতা নেই, পাপড়ি ঝরে যাচ্ছে। গত বছর দুই লাখ টাকার গোলাপ বিক্রি করেছিলাম। এবার ৫০ হাজার টাকারও বিক্রি হবে না।
গদখালীর চাষি রহমত আলী বলেন, পাতা শুকিয়ে পড়ে যাচ্ছে, পচন লেগেছে পাপড়িতে। যেখানে হাজার পিস গোলাপ পাওয়ার কথা, সেখানে তিনশ’র বেশি তুলতে পারছি না। ওষুধের দোকানির কাছ থেকে শুনে রেডিমিল নামে একটি ওষুধ দিয়েছিলাম, কোনও কাজ হয়নি।
ফুল ঝরে পড়া রোধে কৃষি কর্মকর্তারা কোনও পরামর্শ দিয়েছেন কিনা জানতে চাইলে রহমত আলী বলেন, ‘কৃষি কর্মকর্তারা মাঠেই তো যান না, কীভাবে পরামর্শ নেবো। আমার ক্ষেতের ৬০ শতাংশ গোলাপ নষ্ট হয়ে গেছে। অধিকাংশ বাগানের অবস্থা একই। এরপরও কোনও পরামর্শ দিতে আসেননি কৃষি কর্মকর্তারা।
একই কথা জানালেন পাটুয়াপাড়ার কৃষক শওকত আলী। তিনি বলেন, ‘গোলাপের পচন ও ঝরে পড়া রোধে রিভার্স নামের একটা ওষুধ ব্যবহার করেছিলাম। কুয়াশার কারণে বাগানের ৬০ শতাংশ গাছ নষ্ট হয়ে গেছে। দেড় বিঘা জমি থেকে চারশ’ গোলাপ বাজারে এনেছি। সাড়ে ৯ টাকা দরে বিক্রি করেছি।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, যশোরের প্রায় দেড় হাজার হেক্টর কৃষিজমিতে প্রায় ছয় হাজার কৃষক ফুল চাষের সঙ্গে জড়িত। দেশের মোট ফুলের চাহিদার ৭৪ শতাংশ এই জেলা থেকে সরবরাহ করা হয়। প্রতি বছর ডিসেম্বর মাস থেকে গদখালীর ফুলের চাহিদা ও বিক্রি বাড়তে থাকে। সেই সঙ্গে বাড়ে দামও।
মৌসুমের শুরুতে গদখালীর ফুলের বাজার বেশ ভালো, দামও আশানুরূপ ছিল বলে জানিয়েছেন যশোর ফুল উৎপাদন ও বিপণন সমবায় সমিতির সভাপতি আব্দুর রহিম। তিনি বলেন, এবার ফুলের বাজার থেকে ১০০ কোটি টাকার ওপরে ফুল বিক্রির আশা ছিল। কিন্তু বৈরি আবহাওয়া বিশেষ করে বৃষ্টি, ঘন কুয়াশা আর অতিরিক্ত ঠান্ডায় গোলাপ, গ্লাডিওলাস ও গাঁদা ফুল নষ্ট হয়ে গেছে। এতে চাষিরা লোকসানের মুখে পড়েছেন। ফেব্রুয়ারি মাসের উৎসব সামনে রেখে মূলত চাষিরা বাগান পরিচর্যা করে থাকেন। কিন্তু গোলাপের কুঁড়ি নষ্ট হলে আগামীর পূর্ণাঙ্গ ফুলও নষ্ট হয়ে যায়। পাতা ঝরে পড়ে যাওয়ায় গাছের খাদ্য তৈরিও বন্ধ হয়ে গেছে। এসব কারণে গোলাপের বাজার থেকে পাঁচ কোটি টাকার লোকসানের মুখে পড়েছি আমরা।
ফুল ঝরে পড়া রোধে চাষিদের কোনও পরামর্শ দেয়া হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে ঝিকরগাছা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাসুদ হাসান পলাশ বলেন, ‘বাগান পরিদর্শন করে জানতে পেরেছি, চায়না গোলাপ বিশেষ করে যেসব গাছের বয়স এক বছরের কম, সেগুলোতে এই সমস্যা দেখা দিয়েছে। মূলত বেশি সার প্রয়োগ, পাঁচবারের বেশি সেচ দেয়া, বৃষ্টি ও ঘন কুয়াশার কারণে পাতা স্যাঁতসেঁতে হয়ে গেছে। গাছের গোড়ায় ফাঙ্গাস দেখেছি। গতকাল বিকেলে ফুল চাষি ইসমাইলের শেডে সব গোলাপ চাষিকে আসতে বলেছি। পাশাপাশি কীট ও ছত্রাকনাশক বিক্রেতাদের ডেকেছি। সবাইকে নিয়ে বসে চাষিদের হাতেকলমে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। আপাতত গোলাপ গাছের গোড়া শুকনো ও ছত্রাকমুক্ত করতে চাষিদের ডলোমাইট ও জিপসাম ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছি আমরা।
প্রসঙ্গত, যশোরে গত ১৮ জানুয়ারি ভোর থেকে দিনভর থেমে থেমে বৃষ্টি হয়েছিল। ওই দিন জেলায় বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছিল ২২ মিলিমিটার। সেদিন তাপমাত্রা ছিল ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর আগের দিন ১০ দশমিক ৮ ডিগ্রি। সোমবার ৯ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়।
শিরোনাম:
- আলুর দাম লাগামহীন ভোক্তার নাভিশ্বাস
- শীতে ফুটপাতে গরম কাপড় বিক্রির ধুম
- একটা সংস্কার কমিটি দিয়ে সংবিধান সংস্কার সম্ভব না: মির্জা ফখরুল
- নিখোঁজের ৩ দিন পর কপোতাক্ষ নদে মিলল বৃদ্ধার মরদেহ
- কৃষ্ণনগরে আরাফাত কোকো স্মৃতি ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন রতনপুর
- পাখির সাথে মানুষের ভালোবাসার গল্প !
- সব রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখবে বাংলাদেশ: প্রধান উপদেষ্টা
- যশোর মটর পার্টস ব্যবসায়ী সমিতির নির্বাচন সংস্কার ও উন্নয়ন পরিষদের পক্ষে ২৭টি মনোনয়নপত্র ক্রয়