বাংলার ভোর প্রতিবেদক
৮ ডিসেম্বর রোববার সন্ধ্যায় প্রতিবেশীর বাড়িতে টেলিভিশন দেখে ফেরার পথে নিখোঁজ হন যশোরের চৌগাছা শহরের রাবেয়া বেগম নামে এক গৃহবধূ। দুই দিন নিখোঁজ থাকার পর ১০ ডিসেম্বর সকালে প্রতিবেশী তাজুল ইসলামের বাড়ির পাশে রাবেয়া বেগমের ব্যবহৃত একটি জুতা ও ছোট টর্চলাইট পড়ে থাকতে দেখেন স্বজনেরা। সেখানে খোঁজ করে একটি পরিত্যক্ত গর্তে পাওয়া যায় রাবেয়ার অর্ধগলিত নিথর দেহ। এই ঘটনায় একটি মামলা হলে পুলিশ একজনকে আটক করলেও অধরা আরোও অনেকেই।
৩০ নভেম্বর চৌগাছা উপজেলার সিংহঝুলি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আনিসুর রহমানকে (৫৫) কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ২২ বছর আগে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন আনিসুরের ভাই সিংহঝুলি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) তৎকালীন চেয়ারম্যান আশরাফ হোসেন। স্বজনদের অভিযোগ, দুই ভাইকে হত্যা করেছে একই পক্ষ। হত্যা মামলার মূল আসামিরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকায় এভাবে ঘটছে হামলার ঘটনা, নিহতের পরিবারগুলোর অবস্থা নাজেহাল। শুধু রাবেয়া বেগম কিংবা আনিসুর রহমান নয়, গত চার মাসে যশোর জেলায় অন্তত ৩৮জন খুন হয়েছেন। অপরাধ প্রবণতা বেড়েছে খুলনা বিভাগের অন্য জেলাগুলোতেও।
পরিসংখ্যান বলছে, গত চার মাসে খুলনা বিভাগে ২০৮জন হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে শীর্ষে সাতক্ষীরা জেলায় ৪৫ জন, যশোরে ৩৮জন, কুষ্টিয়ায় ৩২জন, বাগেরহাটে ১৯জন, খুলনা ১৬জন, ঝিনইদহে ১৫ জন, নড়াইলে ১৩ জন, চুয়াডাঙ্গায় ১০ জন, মেহেরপুরে ৬জন, মাগুরায় ৬জন, খুলনা মহানগরে ৮জন।
প্রতিনিয়ত এসব জেলায় নিথর দেহ সামনে নিয়ে স্বজনদের কান্নায় কখনো ভারি হচ্ছে হাসপাতাল, কখনো বাসা-বাড়ি বা রাস্তার পাশ। বন্দুকের গুলি, ধারালো অস্ত্রের কোপে মারা গেছেন পরিবারের কোনো না কোনো সদস্য। কিন্তু বিচার চাইতে গিয়েও যেন বড় বিপত্তি। নিহতের পরিবারগুলোর ওপর হরহামেশাই চলছে একের পর হামলা। এতে করে বিপর্যস্ত তাদের জীবন।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দীর্ঘদিন পলাতক ও জেলে থাকা চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা স্ব-স্ব এলাকায় ফিরতে শুরু করেছে। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে কিশোর গ্যাং, বখাটে ও উঠতি সন্ত্রাসীরা। পাড়া-মহল্লায় সশস্ত্র মহড়া দিচ্ছে তারা। এতে বেড়েছে হত্যা, প্রতিপক্ষের ওপর হামলা, চাঁদাবাজি ও ডাকাতির ঘটনা। হত্যার কারণ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, অভ্যন্তরীণ কোন্দল, জমি-ঘের দখল নিয়ে বিরোধ, এলাকায় প্রভাব বিস্তার, মাদক বিক্রি, পারিবারিক দ্বন্দ্বসহ বিভিন্ন কারণে ঘটছে এসব অপরাধ। ফলে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা আর শঙ্কায় দিন কাটছে নাগরিকদের। স্থানীয়রা বলছেন, আইনশৃংখলা বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তায় বেড়েছে এসব অপরাধ প্রবণতা। এতে জনমনে চরম আতংক বিরাজের সঙ্গে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন জনসাধারণ। আইনশৃংখলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি নাগরিক সমাজের। আর পুলিশ বলছে আইনশৃঙ্খলা কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতে মাঠে রয়েছে পুলিশ।
এ বিষয়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান পুনম চক্রবর্তী বলেন, একের পর এক হত্যা, ডাকাতি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা কম। যার সুযোগ নিচ্ছে সন্ত্রাসীরা। একই সাথে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে হাসিলের জন্য উদ্ভুত পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হচ্ছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রকে কঠোর হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
যশোর সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি শাহীন ইকবাল বলেন, আইনশৃঙ্খলাবাহিনী বিগত সরকারের সময়ে নানা অপকর্ম করেছে। নিজেদের অপকর্ম ও বিগত সরকারের অপকর্মে ব্যাপক জনরোধে পড়ে মানসিক মনোবল হারিয়ে সাহসের সঙ্গে কাজ করতে পারছে না দাবি সচেতন মহলের। ফলে তাদের নিষ্ক্রিয়তায় বেড়েছে এসব অপরাধ প্রবণতা। এতে জনমনে চরম আতংক বিরাজের সঙ্গে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন জনসাধারণ। আইনশৃংখলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন তিনি। একই সাথে আইনশৃঙ্খলা সমুন্নত রাখতে নতুন করে পুলিশ বাহিনীকে ঢেলে সাজানোর পরামর্শও দেন তিনি।
এ বিষয়ে যশোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নূর-ই-আলম সিদ্দিকী বলেন, আসলে ভিন্ন ভিন্ন কারণে এ হত্যার ঘটনাগুলো ঘটছে। তবে পুলিশ তৎপর রয়েছে হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িতদের আটকের জন্য। আর কেন এত হত্যাকাণ্ড ঘটছে এ বিষয়ে মোটিভ খোঁজার চেষ্টা করছে পুলিশ। তিনি আরো জানান, জমিজমা সংক্রান্ত, পারিবারিক কলহ ও পূর্ব শত্রুতার জেরসহ নানা কারণে এ হত্যাকান্ডগুলো ঘটছে। এছাড়া হত্যায় জড়িতদের আটকের উদ্দেশ্যে পুলিশসহ একাধিক আইন শৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করছে।
বিভাগীয় পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তা রেঞ্জ ডিআইজি মো. রেজাউল হক জানান, খুলনা বিভাগে ভালো রয়েছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। আস্থা রাখতে বললেন পুলিশের ওপর।