বাংলার ভোর প্রতিবেদক
আনিসুর রহমান লিটন ওরফে ফিঙে লিটন। অস্ত্র মামলায় দশ বছরের সাজাপ্রাপ্ত হয়ে আত্মগোপনে চলে যান তিনি। টানা প্রায় দুই যুগ ধরে দেশের বাইরে থাকলেও যশোরের মানুষের কাছে আতংকের নাম ‘ফিঙে লিটন’। দেশের বাইরে থেকেই নিয়ন্ত্রণ করতেন যশোরের নানা সিন্ডিকেট। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, চাঁদাবাজি ও একাধিক খুনের ঘটনায় ফিঙে লিটনের নাম জড়িয়েছেন তার অনুসারীরা। কিন্তু পর্দার আড়ালে থাকায় আইনের চোখে তাকে আটকানো যায়নি। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর বদলে গেছে দেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপট। এই সুযোগে দীর্ঘদিন পর দেশে ফিরেছেন আনিসুর রহমান লিটন ওরফে ফিঙে লিটন। বুধবার দুপুরে গোপনীয়তার মধ্যদিয়ে যশোরের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ ফারজানা ইয়াসমিনের আদালতে অস্ত্র মামলায় আত্মসমর্পণ করেন। বিচারক জামিন নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। আনিসুর রহমান লিটন ওরফে ফিঙে লিটন যশোর শহরের বারান্দি মোল্লাপাড়ার বদর উদ্দিনের ছেলে।
এ বিষয়ে কোর্ট ইন্সপেক্টর রোকসানা খাতুন জানান, ‘১৯৯৯ সালে অস্ত্র আইনের একটি মামলায় আনিসুর রহমান লিটনের ১০ বছর সাজা হয়। এরপর থেকে তিনি পলাতক ছিলেন। ওই মামলায় বুধবার তিনি আত্মসমার্পন করে জামিনের আবেদন করলে আদালত নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।’
যে মামলায় দুই যুগ পর আত্মসমর্পণ:
আদালত সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৮ সালে একটি অস্ত্র আইনের মামলা করেন আনিসুর রহমান লিটনের বাবা বারান্দীপাড়া আমতলার বদরুদ্দীন খন্দকার। মামলায় অস্ত্রসহ আটক হয় সিটি কলেজ পাড়ার প্রদীপ কুমার দাস ওরফে ভোম্বল লিটন। অভিযোগ করা হয়, আনিসুর রহমান লিটনকে হত্যার উদ্দেশ্যে তিনি গুলি করতে এসেছিলেন। পরবর্তীতে স্থানীয়রা প্রদীপকে আটক করেন। পরে তার কাছ থেকে একটি রিভলবার ও গুলি উদ্ধার করা হয়। এসআই মিজানুর রহমানসহ আরও কয়েকজন দফায় দফায় মামলাটি তদন্ত করেন। এ ঘটনার ১০ মাস পর ১৯৯৯ সালের ১৩ জুন কোতোয়ালি থানার তৎকালীন এসআই এমদাদুল হক মূল আসামিদের অব্যাহতির সুপারিশ করেন এবং উল্টো আনিসুর রহমান লিটনের বিরুদ্ধেই অস্ত্র আইনে একটি মামলা করেন। সেখানে উল্লেখ করা হয় শক্রতার জেরে অস্ত্র দিয়ে ওই আসামিদের ফাসানোর চেষ্টা করেন আনিসুর রহমান লিটন। পরে আনিসুর রহমান লিটনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট জমা দেন। সর্বশেষ ২০০৮ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি স্পেশাল ট্রাইবুনাল-৪ এর বিচারক এমএম আমিনুল ইসলাম মামলার রায়ে আনিসুর রহমান লিটনকে ১০ বছরের সশ্রম কারাদন্ডের আদেশ দেন। এরপর থেকেই লিটন পলাতক ছিলেন। বুধবার তিনি আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিনের আবেদন জানালে বিচারক ফারজানা ইয়াসমিন তার জামিন না মঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
এ বিষয়ে আইনজীবী বিএম অনিক ইসলাম দাবি করেছেন, আনিসুর রহমান লিটন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নির্যাতিন হয়েছেন। তার বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা রয়েছে যা ষড়যন্ত্রমূলক। অস্ত্র মামলাটিও ষড়যন্ত্রমূলক মামলা ছিল। বর্তমানে দেশের পরিস্থিতি অনুকুলে আসায় লিটন আদালতে আত্মসমর্পণ করেছেন। তারা এ রায়ের বিপক্ষে উচ্চ আদালতে আপিল করবেন। তাদের বিশ্বাস লিটন ন্যায়বিচার পাবেন। যশোর কোতোয়ালি থানার ওসি আবদুর রাজ্জাক সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরাও শুনি ফিঙে লিটন ইন্টারপোলের মোস্ট ওয়ান্টেড আসামি। কিন্তু আমাদের কাছে তার সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। তবে কোতোয়ালি থানায় তার বিরুদ্ধে তিনটি মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আছে। সব মামলার তথ্য আপডেট নেই। কারণ, এসব মামলা ২০ বছর আগের। তখন সবকিছু ম্যানুয়াল ছিল। এ জন্য পুরোনো সব মামলার তথ্য আপডেট করা নেই। নতুন করে সব মামলার নথিপত্র খুঁজতে হচ্ছে।’
কে এই ফিঙে লিটন:
যশোরের সব শ্রেণিপেশার মানুষ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে আলোচিত নাম ‘ফিঙে লিটন’। ১৯৯৯ সালে অস্ত্র মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে আত্মগোপনে চলে যান। প্রায় দুই যুগ ভারত, নেপাল, দুবাই, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও কাতার অবস্থান করেছেন। জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক হলেও গ্রহণ করেছেন নেপালি পাসপোর্ট। তিনি দীর্ঘদিন ধরে দেশের বাইরে থাকলেও তার নামে ত্রাসের রাজত্ব ছিল যশোরে। তার দাপট কাজে লাগিয়ে অনুসারীদের চাঁদাবাজি, দখল, চোরাচালানি সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ ছিল ওপেন সিক্রেট। তবে পর্দার আড়ালে থেকে কলকাঠি নামায় সরাসরি কোন অপরাধে তাকে সম্পৃক্ততার প্রমাণ করতে পারেনি আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা। তার নামে একটি অস্ত্র মামলা ছাড়া আর কোন মামলা আছে কিনা সেই তথ্যও দিতে পারেনি পুলিশ। দীর্ঘদিন আত্মগোপনে থাকলেও আনিসুর রহমান লিটন আধিপত্য বজায় রেখেছেন তার এলাকা শহরের মোল্লাপাড়া, বারান্দিপাড়া ও মণিহার এলাকায়। নিজে এক সময় বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলেও ২০০৯ সালের পর শেখ হাসিনার সরকারের আমলে পরিবারের সদস্যদের আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় করেছিলেন। ২০২১ সালে যশোর পৌরসভা নির্বাচনে ১ ওয়ার্ড কাউন্সিলর নির্বাচিত হন ফিঙে লিটনের ভাই সাইদুর রহমান রিপন ওরফে ডিম রিপন। তার বিজয়ের নেপথ্যে ফিঙে লিটনের প্রভাব ছিল বলেও জনশ্রুতি আছে। সর্বশেষ ২০২৪ সালের সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হন ফিঙে লিটনের স্ত্রী সদর উপজেলা যুব মহিলা লীগের আহ্বায়ক ফাতেমা আনোয়ার। তিনি স্থানীয় রাজনীতিতে সাবেক এমপি নাবিল আহমেদের অনুসারী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তবে নির্বাচনের আগে বিতর্কিত মন্তব্যের জন্য তাকে যুব মহিলা লীগ থেকে বহিস্কার করা হয়। ফিঙে লিটন দেশের বাইরে থাকলেও দেশে পরিবহন ব্যবসা সম্প্রসারণ করেছেন স্ত্রী ফাতেমা আনোয়ারের নামে। লিটন ট্রাভেল নামে তাদের পরিবহন ব্যবসা রয়েছে। দীর্ঘদিন পরে দেশে ফেরা আনিসুর রহমান লিটন ওরফে ফিঙে লিটন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হবেন, নাকি বিএনপির রাজনীতিতে মাঠে নামবেন সেটি নিয়ে চলছে নানা গুঞ্জন। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, আনিসুর রহমান লিটন যশোরের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। তিনি লিটন ট্রাভেলস এর মালিক। তিনি দীর্ঘদিন বিদেশে থাকাকালে তার স্ত্রী ফাতেমা আনোয়ারের মাধ্যমে এলাকাবাসীর পাশে থেকেছেন। বিশেষ করে করোনাকালীন লিটনের সহযোগিতা তাদের আজীবন মনে থাকবে বলেও মন্তব্য করেছেন অনেকেই।