বাংলারভোর প্রতিবেদক
কোথাও পা রাখার জায়গা নেই। কেউ দাঁড়িয়ে; কেউ বা বসে।
সবার কোলে কিংবা কাঁধে রয়েছে নানা বয়সী শিশু। ঠাণ্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হওয়া প্রিয় সন্তানের চিকিৎসার জন্য অভিভাবকদের এই অপেক্ষা। আবহাওয়া পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই দৃশ্য প্রতিনিয়ত যশোর জেনারেল হাসপাতালের বহিঃবিভাগে। রোগী সামাল দিতে যেয়ে হিশশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক ও দায়িত্বরত কর্মচারীরা।
শুধু এই জেনারেল হাসপাতাল নয়; শহরের খাজুরা নিউ মার্কেটস্থ শিশু হাসপাতালের দৃশ্যও একই।
হাসপাতাল দুটির বহির্বিভাগ ও অন্তঃবিভাগে বেড়েছে শিশু রোগীর ভিড়। ঋতু পরিবর্তনজনিত ঠাণ্ডার কারণে অনেকে কাশি, গলাব্যথা, নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহজনিত জটিলতাসহ জ্বর ও ভাইরাল ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছেন।
সরেজমিনে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে ২৪ সিটের বিপরীতে চিকিৎসীন আছে ৬০জন শিশু। এদিন বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছে চার শতাধিক শিশু।
অপরদিকে যশোর শিশু হাসপাতালে ৫০সিটের প্রত্যেকটিতে রোগী ভর্তি রয়েছে। এখানে সিট বাদে কাউকে ভর্তি করা হয় না। একই হাসপাতালের বহির্বিভাগে সেবা নিয়েছে ৩ শতাধিক শিশু রোগী।
ঠাণ্ডা ও শ্বাসকষ্টে ভুগছে দুই মাস বয়সী শিশু আহনাফ। তাকে নিয়ে যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের বহির্বিভাগের শিশু চিকিৎসকের কাছে এসেছেন বাবা-মা।
চিকিৎসকের চেম্বারের সামনে লম্বা লাইনে দাঁড়ানো শিশুটির পিতা মোহাম্মদ রঞ্জু বললেন, ১৫-২০দিন ধরে শ্বাসকষ্টে ভুগছে ছেলেটি। অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি, সুস্থ হচ্ছে না। আজ সরকারি হাসপাতালে নিয়ে এসেছি। অনেক ভিড় থাকায় লাইনে অপেক্ষায় আছি।
লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা আরেক অভিভাবক তরিকুল ইসলাম বলেন, তার ছয় বছর বয়সী ছেলে আরিয়ান সর্দি, কাশিতে আক্রান্ত। এক সপ্তাহ পার হয়ে গেলেও সুস্থ হয়নি। স্থানীয়ভাবে চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ খাওয়ানো হয়েছে।
কিন্তু সুস্থ হচ্ছে না। শীতের মধ্যে ঠাণ্ডাজনিত সমস্যায় খুবই কষ্ট পাচ্ছে। আজ হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখাতে এসেছি।
বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা শিশু আহনাফ কিংবা আরিয়ান নয়, তাদের মত অসংখ্য শিশু আবহাওয়া পরিবর্তনে ঠাণ্ডাজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
যশোর জেনারেল হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা বেনাপোলের শিশু তাকরিমের মা জুঁই সাথী বলেন, সাড়ে বছর বছরের ছেলেটি এক মাস ধরে ঠাণ্ডাজনিত জ¦রে আক্রান্ত। চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ খাওয়াচ্ছি, কিন্তু সুস্থ হচ্ছে না।
রাতে রাতে জ¦র আসছে। সরকারি হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বসবে শুনে এসেছি। এখানে অনেক রোগীর ভিড়। দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে আছি।
লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা সদর উপজেলার সতীঘাটা এলাকার রুমা খাতুন বলেন, আমার ১৮ মাস বয়সী ছেলের ঠাণ্ডা লেগেছে। দুই দিন ধরে ঠাণ্ডায় খুব কষ্ট পাচ্ছে। অল্প টাকায় ভাল ডাক্তার দেখানোর জন্য এখানে এসেছি। শুধু বহির্বিভাগ নয়, যশোর জেনারেল হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডেও বেড়েছে রোগীর সংখ্যা। ২৪ সিটের বিপরীতে প্রায় তিনগুণ বেশি রোগী ভর্তি রয়েছে।
ঝিকরগাছার ছুটিপুর এলাকার বাসিন্দা তাসলিমা খাতুন বলেন, সর্দি, কাঁশিতে দুই মাস বয়সী নাতনি খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। প্রথমে একটি বেসরকারি ক্লিনিকে ভর্তি করেছিলাম। সেখানে সুস্থ না হওয়ায় চারদিন আগে সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করেছি। এখন নাতনি অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেছে।
শহরের বকচর এলাকার বাসিন্দা অন্তরা খাতুন বলেন, আমার শিশুর বয়স ২৩দিন। গুরুতর অসুস্থ হওয়ায় ৫দিন ধরে নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটে রাখা হয়েছে। আগের চেয়ে এখন অনেকটা সুস্থ হয়েছে।
শিশু ওয়ার্ডের সিনিয়র স্টাফ নার্স সালমা খাতুন বলেন, জনবলের তুলনায় রোগীর চাপ বেশি হলে সেবা দিতে আমাদের হিমশিম খেতে হয়। রোগীর চাপ বেশি হওয়ায় মেঝেতে রেখেও চিকিৎসা দেয়া হয়। যশোর শিশু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন চার মাস বয়সী এক শিশুর পিতা কামরুল ইসলাম মুকুল বলেন, আমার শিশু ওজন কমে জন্ম হয়েছিল।
তাকে অনেকদিন এনআইসিইউতে রাখতে হয়েছিল। চারদিন হলো ঠাণ্ডা জনিত সমস্যা নিয়ে এই হাসপাতালে ভর্তি করেছি। এখানকার পরিবেশ ও চিকিৎসা ভাল। শিশু সুস্থতার দিকেই যাচ্ছে।
যশোর শিশু হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. সৈয়দ নূর-ই-হামীম বলেন, শীতে ঠাণ্ডা, কাঁশি, নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট, ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগী বাড়ছে। দুইদিন হলো-ঠাণ্ডাজনিতে রোগে আক্রান্ত বেড়েছে। হাসপাতালের ৫০ শয্যা খালি নেই। বহির্বিভাগেও বেড়েছে রোগীর সংখ্যা।
শিশুদের সুরক্ষায় অভিভাবকদের সচেতন থাকার পরামর্শ দিয়ে ডা. সৈয়দ নূর-ই-হামীম বলেন, খাবারের মাধ্যমে শিশুদের পেটে জীবাণু প্রবেশ করে। জীবাণুর কারণে শিশুরা অসুস্থ হয়।
খাবারের মাধ্যমে পেটে যাতে জীবাণু প্রবেশ করতে না পারে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। শীত নিবারণে গরম কাপড় পরিধান করাতে হবে। পানিশূণ্যতা রোধে শিশুদের বেশি বেশি মায়ের বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। স্যালাইন ও ডাবের পানি খাওয়াতে হবে।
যশোর জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক (ভারপ্রাপ্ত) ডা. হুসাইন সাফায়েত বলেন, শীতের প্রকোপ বাড়ছে। সেই সাথে ঠাণ্ডাজনিত রোগীও বাড়ছে। শিশু ওয়ার্ডে ২৪ সিটের বিপরীতে তিন থেকে চারগুণ বেশি রোগী চিকিৎসা দিতে হচ্ছে।
জনবল ও অবকাঠামো সংকট থাকলেও সেবা অব্যাহত আছে।
বহির্বিভাগেও প্রতিদিন ৪শ’ থেকে ৫শ’ শিশু রোগীর চিকিৎসা পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। চিকিৎসা কার্যক্রম স্বাভাবিক আছে।

