বাংলার ভোর প্রতিবেদক
হাতে সিভি আর চোখে একরাশ স্বপ্ন নিয়ে সাতসকালে যশোর কারিগরি ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের মাঠে হাজির হয়েছিলেন হাজারো বেকার তরুণ তরুণী। সবারই প্রত্যাশা মনের মতো একটা চাকরি। যা দিতেই এই কেন্দ্রের মাঠে আয়োজন করা হয় চাকরিমেলা। যশোর কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং মানবাধিকার সংস্থা রাইটস যশোর যৌথভাবে দিনব্যাপি এই চাকরিমেলার আয়োজন করে। এতে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে উইনরক ইন্টারন্যাশনালের আশ্বাস প্রকল্প।
বৃহস্পতিবার সকালে কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায় যুবক-যুবতীদের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠেছে পুরো এলাকা। আগতদের প্রায় সবার হাতে বাদামি, সাদা, হলুদ খাম-যেগুলোতে যত্ন করে রাখা আছে তাদের জীবন বৃত্তান্ত। অনেকে মেলার আশপাশে যেখানে সুযোগ পাচ্ছেন সেখানে দাঁড়িয়ে বা বসে জীবন বৃত্তান্ত লিখছেন বা সংশোধন করছেন। প্রতিটি স্টলের সামনে ছিল বিশাল জটলা। যার এক পাশে নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতেগোণা কয়েকজন কর্মী, অন্যপাশে বিপুল সংখ্যক চাকরি প্রত্যাশী। টেবিলগুলোতে সাজানো ছিল চাকরি প্রত্যাশীদের জমা দেয়া জীবন বৃত্তান্তগুলো।
যশোর সদর উপজেলার সাতমাইলের পল্লব নিজের বায়োডাটার ছয়টি কপি নিয়ে এসেছিলেন চাকরি মেলায়। এখানে বসা চাকরি মেলায় অংশ নেয়া বিভিন্ন নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠানের স্টলে ঘুরে ঘুরে নিজের যোগ্যতা ও চাহিদা অনুযায়ী পদ পাওয়া যাচ্ছে যেসব প্রতিষ্ঠানগুলোতে সিভি (জীবন বৃত্তান্ত) জমা দিয়েছেন তিনি। পল্লব সাতমাইলের মহিদুল আলমের ছেলে। এইসএসসি পাশ করার পর আর লেখাপড়া করেননি। পিতার সাথে নিজেদের জমিতে চাষাবাদই তার পেশা। এর আগে আর কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরির জন্য আবেদনও করেননি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আসলে সামান্য লেখাপড়া করে কোনো চাকরি পাওয়া মুশকিল। তাছাড়া, এর পিছনে দৌঁড়ানোরও সুযোগ কম। তাই যখন শুনলাম বাড়ির কাছে চাকরি দিতে এসেছে অনেক কোম্পানি, তাই সুযোগটা নিলাম।’ ‘চাকরি হোক বা না হোক, একসাথে এতগুলো প্রতিষ্ঠানের সাথে কথা বলার অন্তত একটা যুযোগ পাওয়া গেছে চাকরিমেলায়, একটা অভিজ্ঞতা হয়েছে, এটাই অনেক ব্যাপার’-বলেছেন যশোর শহরের বারান্দিপাড়া থেকে আসা মাস্টার্সের শিক্ষার্থী তানজিনা আফরিন।
যশোর চাকরিমেলায় দেশের ২০টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে স্টল খোলা হয়। যেসব পদগুলোতে জনবল নিয়োগের সম্ভাবনা রয়েছে তার তালিকা, শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং বেতন/মজুরি কাঠামোও প্রদর্শন করা হয় স্টলে। ছিলেন প্রশিক্ষিত কর্মীবাহিনী ও কর্মকর্তা, যারা চাকরিপ্রার্থীদের নানা প্রশ্নের জবাব দেন। অনেক প্রতিষ্ঠান চাহিদা অনুযায়ী জনবল পেলে সাথে সাথেই তাদেরকে নিয়োগ দিচ্ছে বলেও জানানো হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের একটি আরএফএল গ্রুপ। এই প্রতিষ্ঠানে প্রায় তিনশ’ সিভি জমা পড়েছে। তাদের মধ্য থেকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে ৫০ জনকে। এই তথ্য জানান, মেলাস্টলে দায়িত্ব পালনকারী ঢাকা থেকে আসা সহকারী ম্যানেজার দেবাশীষ সরদার। তিনি জানান, যাদেরকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে তাদের মধ্যে সেলস এ বেশি। এছাড়া, সার্ভিস টেকনিশিয়ান ও ড্রাইভিং এও নিয়োগ দেয়া হয়েছে। নিয়োগপ্রাপ্তদেরকে কয়েকদিনের মধ্যেই চাকরিতে যোগদানের আমন্ত্রণ জানানো হবে বলে জানান দেবাশীষ সরদার।
আয়েশা আবেদ ফাউণ্ডেশনের যশোর ব্রাঞ্চের অ্যাডমিন অফিসার মাসুদুজ্জামান জানান, দুপুর পর্যন্ত তারা সুইং অপারেটর, মোমবাটিক অপারেটর এবং হ্যান্ডস্টিচ ওয়ার্কার পদে বেশ কয়েকজনকে নিয়োগ দিয়েছেন। নিয়োগ পাওয়াদের মাঝে নারীদের সংখ্যাই বেশি। তাদের মধ্যে অনেকে মানব পাচারের শিকার। ফিরে আসার পর এখন তারা জীবনে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন।
রাইটস যশোরের নির্বাহী পরিচালক বিনয় কৃষ্ণ মল্লিক বলেন, মূলত মানব পাচারের সার্ভাইভারদের কর্মসংস্থানের সুযোগ দিতে এই চাকরিমেলার আয়োজন করা হয়েছে। এর সাথে অন্যান্য বেকার যুবক-যুবতীরাও মেলাস্টল থেকে প্রতিষ্ঠানগুলোতে চাকরির সুযোগ লাভ করছেন।
মেলাস্টলে দায়িত্ব পালনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তারা জানালেন, সাধারণত চাকরিতে নিয়োগের জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে হয়। তাতেও অনেক সময় যোগ্য কর্মী পাওয়া যায় না। মেলার কারণে এক সাথে একাধিক প্রার্থীর সাথে সরাসরি আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। উভয়পক্ষের চাহিদা ও যোগ্যতার নিরিখে যাদেরকে উপযুক্ত মনে করা হচ্ছে তাদের বায়োডাটা সংগ্রহ করা হচ্ছে। তার মানে প্রাথমিক একটা সিলেকশনের সুযোগ এই মেলা থেকেই হয়ে যাচ্ছে। আবার অনেককে তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী নিয়োগও দেয়া হচ্ছে। এতে নিয়োগদাতা ও চাকরিপ্রার্থী উভয়েরই উপকার হচ্ছে।
বৃহস্পতিবার সকালে চাকরিমেলার উদ্বোধন করেন যশোরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) খান মাসুম বিল্লা। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন যশোর কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের অধ্যক্ষ প্রকৌশলী গাজী ইকফাত মাহমুদ। বিশেষ অতিথি ছিলেন রাইটস যশোরের নির্বাহী পরিচালক বিনয় কৃষ্ণ মল্লিক এবং উইনরক ইন্টারন্যাশনালের সিনিয়র ম্যানেজার জি এফ রব্বানী। আয়োজকরা জানিয়েছেন, মানব পাচারের একটা বড় কারণ দারিদ্র্য। ফলে যারা পাচারের পর ফিরে আসে তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করতে পারলে পাচারের ঝুঁকি কমে না। সেই বিবেচনা থেকেই সারভাইভারদেরকে কাজের টার্গেট করে এই মেলার আয়োজন করা হয়েছে। মেলায় স্টল দেয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথেও সে ধরনের আলোচনা হয়েছে বলে জানান আয়োজকরা।

