বাংলার ভোর প্রতিবেদক
যশোর জেনারেল হাসপাতালে রোগীর শরীরে তিন ব্যাগ ভিন্ন গ্রুপের রক্ত দেয়া ওই বৃদ্ধার জীবন সংকটাপন্ন হয়ে উঠেছে। হাসপাতালের বেডে শুয়ে বর্তমানে মৃত্যুর প্রহর গুণছেন ৭৭ বছর বয়সী বৃদ্ধা সালেহা বেগম। বৃদ্ধার স্বজনরা জানান, সালেহার স্বাস্থ্যের দিন দিন অবনতি হচ্ছে। পুরনো রোগের সঙ্গে নতুন করে সমস্যা দেখা দিয়েছে বোনম্যারো, কিডনি ও হার্টের। এমন অবস্থায় উৎকণ্ঠায় শয্যাশায়ী ওই বৃদ্ধার স্বজনেরা।
গত ৬ জুন হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক গৌতম কুমার আচার্যকে প্রধান করে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করেছে হাসপাতাল প্রশাসন। কমিটিকে আগামী বৃহস্পতিবারের মধ্যে রিপোর্ট জমা দেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বর্তমানে ওই রোগী জেনারেল হাসপাতালের মহিলা পেয়িং ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তিনি যশোরের মণিরামপুর উপজেলার খেদাপাড়া ইউনিয়নের খড়িঞ্চা হেলাঞ্চি গ্রামের মৃত শামসুর রহমানের স্ত্রী।
ভুক্তভোগী রোগীর স্বজনরা জানান, বাধর্ক্যজনিত রোগে গত ২০ মে যশোর মেডিকেল কলেজের এক চিকিৎসকের পরামর্শে যশোর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয় সালেহা বেগমকে। সালেহার শরীরে রক্তশূন্যতার কারণে রক্ত দেয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসক। রক্ত দেয়ার জন্য হাসপাতালের ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগে গিয়ে সালেহার রক্তের গ্রুপ নির্ণয় করেন স্বজনরা। সেখানে সালেহার রক্তের গ্রুপ আসে বি পজিটিভ। এরপর ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগের দায়িত্বরত কর্মকর্তারা সালেহার স্বজনদের বি পজিটিভ রক্তদাতাকে খুঁজে আনতে বলেন। বি পজিটিভ গ্রুপের রক্তদাতাকে এনে সালেহার শরীরে রক্ত দেয়া হয়। ২০, ২২ ও ২৪ মে তিন দিন তিন ব্যাগ বি পজিটিভ রক্ত দেয়া হয়। তিন ব্যাগ রক্ত দেয়ার পর দুই দিন পর সালেহার পরিবার সালেহাকে গ্রামে নিয়ে যান। গ্রামে গিয়ে সালেহার শরীর জ্বালাপোড়া, বমিসহ খিঁচুনি শুরু হয়।
এসব উপসর্গের কারণে স্থানীয় চিকিৎসকদের পরামর্শে তাকে বিভিন্ন চিকিৎসা দেয়া হয়। সর্বশেষ ২ জুন সোমবার বিকেলে অবস্থার অবনতি হলে আবারও যশোর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালের চিকিৎসক সালেহাকে আবারও রক্ত দেয়ার পরামর্শ দেন।
চিকিৎসকের পরামর্শে তিন জুন মঙ্গলবার সকালে বি পজিটিভ রক্তদাতাকে নিয়ে সালেহাকে রক্ত দিতে গেলে সেই ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগের দায়িত্বরত কর্মকর্তারাই বলেন, সালেহার রক্তের গ্রুপ বি পজিটিভ না।
তার রক্তের গ্রুপ এ পজিটিভ। এরপর রোগীকে ভিন্ন গ্রুপের রক্ত দেয়ার বিষয়টি জানাজানি হলে রোগীর স্বজনেরা হট্টগোল শুরু করেন। পরবর্তীকালে হাসপাতালের কর্মকর্তারা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।
সোমবার দুপুরে সরেজমিনে যশোর জেনারেল হাসপাতালের মহিলা পেয়িং ওয়ার্ডে যেয়ে দেখা যায়, ভুক্তভোগী রোগী হাসপাতালের বেডে শয্যাশায়ী। কোন কথা বলতে পারছেন না। মানুষের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রয়েছেন। স্বজনের ভাষ্য মৃত্যু পথযাত্রী সালেহা বেগমকে দেখতে আসছে স্বজনেরা। অনেকেই বেডে বৃদ্ধাকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করছেন। হাসপাতালের নার্সের সঙ্গে নিয়মিত দেখাশোনা করছেন তার তিন মেয়ে।
বৃদ্ধার মেয়ে নিলুফা ইয়াসমিন বলেন, ‘মায়ের দিন দিন স্বাস্থের অবনতি হচ্ছে। কিছু খেতে পারছে না। শরীর একদম রুগ্ন হয়ে গেছে। হাসপাতালে যখন মাকে নিয়ে আসি, তখন আমাদের হাত ধরে হেঁটে হাসপাতালের চার তলাতে উঠেছিলো।
এখন মাকে তিন চারজন কোলে তুলে টয়লেটে নিয়ে যাওয়াসহ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করতে হচ্ছে। কান্নাজড়িত কন্ঠে তিনি আরো বলেন, চিকিৎসকের পরামর্শে মাকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছিলাম সুস্থ্য করতে, অথচ আমার সেই মা এখন মৃত্যু পথযাত্রী। চিকিৎসকের পরামর্শে মায়ের বিভিন্ন পরীক্ষা করেছি। সেখানে মায়ের বোনম্যারোর সমস্যা দেখা দিয়েছে।
ভুল রক্ত দেয়ার আগে মায়ের কিডনির রেঞ্জ ছিলো ১.৫০। এখন সেটি ফুলেফেঁপে ২.২২ হয়েছে। প্রস্রাবের নালীতে ইনফেকশন, দেখা দিয়েছে হার্টের সমস্যা। এখানকার চিকিৎসকরা মাকে বিভিন্ন চিকিৎসা দিচ্ছে এটা সত্য। তবে তারা বলছেন মাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকাতে নিয়ে যেতে। তবে পরিবারের বাধ্যবাধকতার জন্য সেখানে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না।’
ভুক্তভোগী ওই রোগীর আরেক মেয়ে শিরিনা আক্তার বলেন, ‘হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংকের ভুলের কারণে আমার মা এখন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। তিনি এখন খুব অসুস্থ। তার শরীরের অবস্থা দিন দিন অবনতি হচ্ছে। সুস্থ করার জন্য আমার মাকে হাসপাতালে এনেছি, এখন তার অবস্থা খারাপ। এই ঘটনার বিচার চাই।’
এদিকে, এই ঘটনায় গত ৬ জুন হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক গৌতম কুমার আচার্যকে প্রধান করে চার সদস্যের একটি কমিটি করেছে হাসপাতাল প্রশাসন। এই বিষয়ে গৌতম কুমার আচার্য বলেন, ‘রোগী শঙ্কামুক্ত নয়। রোগীর নিয়মিত চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। আমরা তদন্তের কাজ শুরু করেছি। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কিছু বলা যাবে না।’
হাসপাতালের তত্বাবধায়ক হারুন আর রশিদ বলেন, ‘রোগীর যাবতীয় চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে, হাসপাতাল থেকে। তবে রোগীর অবস্থা সংকটাপন্ন। ঘটনা ঘটার পরে ভুক্তভোগী রোগীদের স্বজনদের অভিযোগে তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। তাদেরকে এক সপ্তাহের সময় দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, রোগীর রক্তে হিমোগ্লোবিনের সঙ্গে রক্তের কিছু উপাদানও কম রয়েছে।
যার কারণে রক্তের গ্রুপ নির্ণয় করতে বেগ পেতে হয়েছে ট্রান্সফিউশন মেডিসিন কর্মীদের। যার ফলে এমন সমস্যা হতে পারে। তার পরেও তদন্ত করা হচ্ছে। কারও কোনো গাফিলতি থাকলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’