স ম নজরুল ইসলাম, কপিলমুনি: প্লাস্টিকসহ আধুনিক বিভিন্ন মাদুরের ভিড়ে বিলুপ্তপ্রায় কপিলমুনির ঐতিহ্যবাহী ম্যালির তৈরি মাদুর। প্রয়োজনীয় পুঁজি, কাঁচামাল ও উপকরণের দুষ্প্রাপ্যতাসহ নানা সংকট ম্যালির তৈরি মাদুর শিল্প বিলুপ্তির প্রধান কারণ বলে মনে করছেন শিল্প সংশ্লিষ্টরা। এমন অবস্থায় অনেকেই ইতোমধ্যে পেশা বদল করেছেন। বাপ-দাদার পেশা আঁকড়ে এখনো যারা মৃতপ্রায় শিল্পটিকে পাহারা দিচ্ছেন তারাও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশঙ্কায় অপেক্ষা করছেন পেশা বদলের।
কপিলমুনির কাশিমনগরের আগরাসহ কয়েকটি গ্রামে মাদুর তৈরির প্রধান উপকরণ ম্যালির উৎপাদনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে তৃণমূলের মাদুর শিল্প এলাকা। চাহিদার সাথে সংগতি রেখে মৌসুমের একটা বড় সময় জুড়ে শিল্পীরা ব্যস্ত থাকতেন ম্যালি দিয়ে মাদুর তৈরিতে।
সময়ের পরিক্রমায় ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকায় লোনা পানির চিংড়ি চাষের ফলে মারাত্মকভাবে হ্রাস পায় ম্যালির উৎপাদন। ওই সময় এলাকার চাহিদা মিটিয়েও দেশের অন্যান্য এলাকায় পাঠানো হতো কপিলমুনির ম্যালি ও মাদুর। আর এখন পর্যাপ্ত উৎপাদন না হওয়ায় শুধু এলাকার চাহিদা পূরণেও হিমশিম খেতে হচ্ছে সংশ্লিষ্টদের। মাদুর শিল্পের এমন দুরবস্থার কারণ সম্পর্কে জানা যায়, মাদুরের প্রধান উপকরণ ম্যালির চাষ এখন একবারেই কমে গেছে। দুই-এক জন যারা আবাদ করেন তার দামও গগনচুম্বী। একদিকে আধুনিক প্লাস্টিক শিল্পের আধিক্যে চাহিদা কম অন্যদিকে একটি মাদুর তৈরিতে যে পরিমাণ খরচ হয় বাজারে তেমন দাম পাওয়া যায় না। বাণিজ্যিকভাবে আগের মতো এখন আর ম্যালির চাষ হয় না। অপ্রয়োজনীয় পতিত জমি কিংবা মাছের পাশাপাশি সাথী আবাদ হিসেবে শিল্প সংশ্লিষ্ট কিছু এলাকায় হাতে গোনা কয়েকজন ম্যালির আবাদ করেন। আবার কেউ কেউ নিতান্তই শখের বশে চিংড়ি ঘেরের পাশে অনুৎপাদিত ম্যালির সংরক্ষণ করে সংশ্লিষ্ট শিল্পীদের দিয়ে তৈরি করিয়ে নেন চাহিদা মাফিক মাদুর। এরপর উদ্বৃত্ত ম্যালি বিক্রি করে দেন শিল্পীদের কাছে। এভাবে কোনো রকম জোড়া-তালি দিয়ে চলছে দক্ষিণের ঐতিহ্যবাহী শিল্পটি।
শিল্প সংশ্লিষ্ট অনেকেই ক্ষোভের সাথে বলেন, সবুজ শ্যামল কপিলমুনির প্রান্তর জুড়ে এখন যতদূর চোখ যায় শুধু ঘের আর ঘের। তাই ইচ্ছার বিরুদ্ধে প্রভাবশালী চিংড়ি চাষিদের হাতে তুলে দিতে হয় এক খণ্ড চাষের জমিও। আলাদা হারি বা ইজারা নিয়ে আবাদ করতেও প্রয়োজন অতিরিক্ত টাকার। সরকার শিল্পটিকে টিকিয়ে রাখতে অলাভজনক এ শিল্পে চালু করেনি কোনো প্রকার ব্যাংক ঋণ।
মাদুরের দক্ষিণ খুলনার অন্যতম প্রধান মোকাম কপিলমুনির মাদুর ব্যবসায়ী সুকুমার ও পবিত্র মণ্ডল জানান, শিল্পীদের শ্রম বাদে একটি মাদুর বুননে কাঁচামাল বাবদ খরচ হয় ২৫০ টাকা থেকে ৩৫০ টাকা। তবে চাহিদা না থাকায় মাদুর প্রতি তাদের লাভ হচ্ছে ৫০/৬০ টাকা। অথচ একটি মাদুর বুননে শিল্পীদের ১ থেকে ২ দিন পর্যন্ত সময় লেগে থাকে। একই সময়ে ভিন্ন পেশায় শ্রম বিক্রি করলে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত পাওয়া যেত।
শিল্পী পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠরা জানান, মাদুর শিল্পের এমন দুরবস্থায় ঠিক কতদিন তা টিকে থাকবে এমন আশঙ্কা রীতিমত ভর করেছে তাদের। তাদের পরবর্তী প্রজন্মও উৎসাহ হারাচ্ছে এ শিল্পে।
এমন অবস্থায় শিল্পটিকে টিকিয়ে রাখতে তারা সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জরুরি হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।