♦একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে নির্বাক যশোরের ইকবালের বৃৃদ্ধা মা
বাংলার ভোর প্রতিবেদক
একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে ষাটোর্ধ মা সুফিয়া বেগম নির্বাক। ঢাকায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যাওয়া শ্রমিক ইকবাল হোসেনের মৃত্যুতে শুধু কাঁদছেন আর বুক চাপড়াচ্ছেন। মঙ্গলবার ঘটনাটি জানার পর থেকেই কোনো দানাপানি মুখে নেননি মা। তিনি বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না তার একমাত্র ছেলে আর ফিরবেন না। কথা ছিল ঈদের ছুটিতে ছেলে বাড়িতে আসবে। কিন্তু সেই আসা আসবে; কিন্তু জীবিত নয়, লাশ হয়ে।
সাভারে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে ইউটার্ন নির্মাণের জন্য সড়কে রাখা সিমেন্টের পিলারের সঙ্গে ধাক্কা লাগায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উল্টে যায় একটি তেল বোঝাই লরি। এ সময় তেল বোঝাই লরিটিতে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠে। এ সময় পাশে এবং পেছনে থাকার একটি প্রাইভেটকারসহ আরও চারটি গাড়িতে ছড়িয়ে পড়ে। এতে ঘটনাস্থলেই অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যায় সিমেন্ট বোঝাই ট্রাকের লেবার ইকবাল হোসেনসহ দু’জন। অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় ৮ জনকে উদ্ধার করে ঢাকার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে পাঠানো হয়। ইকবালের বাড়ি যশোরের চৌগাছা উপজেলার সুখপুকুরিয়া ইউনিয়নের বর্ণি গ্রামে। তিনি ওই গ্রামের মৃত আব্দুল আজিজের ছেলে। বর্তমানের ইকবালের নিথর দেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গের হিমঘরে রাখা হয়েছে।
হতদরিদ্র পরিবারের ইকবাল বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। গ্রামে দীর্ঘদিন ভ্যানচালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে আসছিলেন তিনি। কিন্তু ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ায় বছরখানেক আগে বৃদ্ধা মা, স্ত্রী ও দুই মেয়েকে নিয়ে পাড়ি দেন রাজধানী ঢাকার সাভারে। সেখানে বিভিন্ন পরিবহনে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। পাশাপাশি স্ত্রী মঞ্জুয়ারাও স্থানীয় একটি গার্মেন্টস চাকরি করতেন। ১০ দিন আগে পাঁচ বছর বয়সী ইকবালের ছোট মেয়েকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি চৌগাছাতে আসেন মা সুফিয়া বেগম। কথা ছিলো ঈদের দু’দিন আগে ছুটি নিয়ে স্ত্রী বড় কন্যা নিয়ে গ্রামে আসবেন। কিন্তু ঈদের ছুটিতে নয়; জীবন থেকেই ছুটি নিয়ে ফিরছে ইকবালের নিথর দেহ। তাঁর পরিবারেরও চলছে মাতম।
ষাটোর্ধ বৃদ্ধা ইকবালের মা সুফিয়া বেগম আহাজারি করতে করতে বলেন, ‘আমার ছেলেটা জন্ম থেকেই কষ্ট করেছে। অনেক দেনাদায়ে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলো। তাই বছর খানিক আগের তার উপার্জনের ভ্যানটা বিক্রি করে সবাইরে নিয়ে ঢাকাতে গেছিলো। সেখানে একটা বস্তিতে বাসা ভাড়া নিয়ে সবাই একসাথে থাকছিলাম। আমিও সেখানে থাকি। ঈদে আমরা সবাই গ্রামে আসার কথা ছিলো; কিন্তু ঈদের সময় ছুটি গাড়ি পাওয়া যায় না। তাই ইকবালের ছোট মেয়েডা নিয়ে আমি ১০ দিন আগে গ্রামে এসেছি। ঈদের দুইদিন আগে ইকবাল ও তার বউ মেয়েরে নিয়ে গ্রামে আসার কথা ছিলো। ইকবালের ছোট মেয়েকে কোলে নিয়ে বুক চাপড়াতে চাপড়াতে তিনি বলেন, ও আল্লাহ আমরা ইকবালের কই নিয়ে গেলা। ইকবালের বদলে আমারে নিতে পারতা। এখন আমাদের কি হবে। তার বউ বাচ্চাদের কি হবে। এই তোমার বিচার।’
ইকবালের বাড়িতে যেয়ে দেখা যায়, সেখানে আত্মীয় স্বজনের মধ্যে মাতম চলছে। তাদের কান্নায় প্রতিবেশী ও উপস্থিত কেউই কান্না চেপে রাখতে পারছিলেন না। সবাই তার ছোট মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছে। তাকে ঘিরেই নানা শান্তনা দিচ্ছেন ইকবালের প্রতিবেশি স্বজনেরা।
ইকবালের প্রতিবেশি স্থানীয় স্কুল শিক্ষক আরিফুজ্জামান বলেন, ‘ইকবালরা দুই ভাই বোন। তার একটা বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। হতদরিদ্র পরিবারের সংসারে ইকবাল উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। দায়দেনার কারণে স্বপরিবারে ঢাকাতে গিয়েছিলো। কিন্তু তার সেই দায়দেনা পরিশোধ হওয়ার আগে মৃত্যু হলো। এখন তার পরিবারের কি হবে। কিভাবে চলবে তার স্ত্রী সন্তান ও বৃদ্ধা মা। ইকবালের মৃত্যুতে এলাকার পরিবেশ ভারী হয়ে উঠেছে। তিনি জানান, ইকবালের মরদেহ বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল মর্গে রয়েছে। ময়নাতদন্ত শেষে মরদেহ চৌগাছাতে আসবে।
সুখপুকুরিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধ হবিবর রহমান হবি বলেন, সোস্যাল মিডিয়াসহ বিভিন্ন মাধ্যমে নির্মম এই মৃত্যুর খবর শুনে আমিও ব্যক্তিগত ভাবে মর্মাহত। বুধবার সকালে নিহতের পারিবারে গেছি কিন্তু এখানে তো তেমন কেউ থাকে না। জানতে পেরেছি সাভারেই নিহতের ময়নাতদন্ত শেষে মরদেহ বাড়িতে পাঠানো হবে।