হোসনে আরা তান্নি
শিশুদের ভেতরে যেমন জানার আগ্রহ রয়েছে, তেমনই রয়েছে নানা প্রতিভা। আমরা দেখি, একটি শিশু তার প্রথম আঁকিবুঁকি একটা কাঠি দিয়ে মাটির বুকে চর্চা করে। নিজের তৈরি শিল্পে কখনও অপূর্ণতা বা কখনও পরিতৃপ্ত হয়! অপূর্ণতা হলে ফের কাটাকাটি! যতক্ষণ না নিজে তৃপ্ত হয়।
পরিতৃপ্তির বিষয়টি কখনও সহপাঠীদের আবার কখনও বাবা-মা কিংবা ভাই-বোনকে সলাজ ভঙ্গিতে দেখায়। সেখানে কেউ প্রশংসা করলে তার আগ্রহ বাড়ে। এইসব শিশু-কিশোরদের মাঝে লুকায়িত প্রতিভা বিকাশের অন্যতম পিঠস্থান স্কুল।
শৈশব ও কৈশোর সৃজনশীলতা বিকাশের উত্তম সময়। সবার মধ্যেই সৃষ্টিশীল ভাবনা থাকে। প্রাথমিক পর্যায়ে সৃজনশীলতা বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করা উচিত। শব্দের জন্য প্রয়োজন হয় বর্ণের, সুরের জন্য প্রয়োজন হয় ছন্দের। তেমনই মনের ভাবনাগুলোকে প্রকাশের জন্য প্রয়োজন হয় উন্মুক্ত মঞ্চের।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দেয়ালিকা হতে পারে সেই উন্মুক্ত মঞ্চ। মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রেও দেয়ালিকার গুরুত্ব অপরিসীম। নিজের ইচ্ছেকে লেখনীর মাধ্যমে প্রকাশের মধ্যে দিয়ে সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটে।
বিভিন্ন দিবস কিংবা বিদ্যালয়ের বার্ষিক অনুষ্ঠানে আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে দেয়ালিকা প্রকাশের প্রচলন রয়েছে।। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা নিজেদের চারপাশের পরিবেশ, প্রতিবেশ, মনোজগতের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর সুযোগ পেয়ে থাকে। বলা যায়, লেখক বা প্রতিবেদক সম্পাদক কিংবা নকশাকারের হাতেখড়ি ঘটতে পারে দেয়ালিকার মাধ্যমে। সৃজনশীলতা বিকাশে দেয়ালিকা হলো সেই প্ল্যাটফর্ম, যা শিক্ষার্থীকে তাদের আগ্রহগুলি অন্বেষণ করতে এবং বিভিন্ন ধরণের অভিব্যক্তি প্রকাশ ও দক্ষতা বিকাশকে উৎসাহিত করে।
শিক্ষার্থীদের চিন্তাভাবনা গঠন করা, ধারণাগুলি কার্যকরভাবে প্রকাশ করা এবং দর্শকদের সাথে যুক্ত থাকার পদ্ধতি শিখতে সাহায্য করে দেয়ালিকা। এটি ছাত্র-শিক্ষকসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের অনুভূতি জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করে। দলীয়ভাবে কাজ করাকে অনুপ্রাণিত করে দেয়ালিকা। এটি মানুষকে একত্রিত করতে পারে এবং গর্ব ও পরিচয়ের একটি ভাগ করা অনুভূতি তৈরি করতে পারে।
সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনার দক্ষতাকে উন্নীত করতে পারে। কারণ শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির সাথে জড়িত থাকে, তথ্য বিশ্লেষণ করে এবং তাদের নিজস্ব মতামত তৈরি করে। শিক্ষার্থীদের আত্মবিশ্বাস এবং আত্মমর্যাদা বৃদ্ধি করতে পারে। এটি তাদের প্রচেষ্টাকে বৈধতা দেয় এবং তাদের আগ্রহ এবং প্রতিভা অনুসরণ করে চলতে উৎসাহিত করে।
দেয়ালিকা শিক্ষার্থীদের নেতৃত্ব দানসহ সাংগঠনিক দক্ষতা বিকাশ করতে সাহায্য করে। কারণ তারা সহপাঠীদের সহযোগিতা করে, সময়সীমা পরিচালনা করে এবং প্রকাশনা প্রক্রিয়ার তত্ত্বাবধান করে। এটি ছাত্র, শিক্ষক এবং অভিভাবকদের মধ্যে গর্ব ও ঐক্যের অনুভূতি জাগিয়ে তুলতে পারে।
সাধারণত প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে বিভিন্ন দিবস কিংবা বার্ষিক অনুষ্ঠানভিত্তিক প্রকাশিত দেয়ালিকা সংরক্ষণের কোনো পদক্ষেপ থাকে না। ফলে পূর্বের বছরে প্রকাশিত ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের সুপ্ত প্রতিভাগুলো একসময় হারিয়ে যায়। এইক্ষেত্রে প্রতিবছর দেয়ালিকায় প্রকাশিত লেখা কিংবা ছবিগুলোর সম্মিলিতভাবে বর্ষভিত্তিক প্রকাশনা প্রয়োজন। সংকলন আকারে দেয়ালিকার প্রকাশ একদিকে যেমন শিক্ষার্থীদের লেখা সংরক্ষণ করবে, অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের পরবর্তী জীবনে সৃজনশীলতা বিকাশে আগ্রহী করে তুলবে।
লেখক: উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও), বাঘারপাড়া, যশোর।