বাংলার ভোর ডেস্ক
ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে সোমবার পদত্যাগ করে পালিয়ে ভারতের আশ্রয় নিয়েছেন শেখ হাসিনা। অথচ ২০০৯ সালে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে ব্যাপক ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতার চেয়ারে বসেছিল তার দল আওয়ামী লীগ। সরকার প্রধান হিসেবে দীর্ঘ ১৬ বছর দেশ শাসন করেছেন তিনি। আর এ সময়ে শুরুর দিকে বিশ্বে গণতন্ত্রের আইকন হিসেবে পরিচিত পেয়েছিলেন তিনি। অথচ, নিজের শেষটা হলো স্বৈরাচার হিসেবে পালিয়ে গিয়ে।
গণতন্ত্রের আইকন থেকে শেখ হাসিনার স্বৈরাচারে পরিণত হওয়া নিয়ে একটি প্রতিবেদন করেছে ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যম বিসিবি। সেই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে কীভাবে তিনি গণতন্ত্রের আইকন থেকে পর্যায়ক্রমে স্বৈরাচারে পরিণত হলেন শেখ হাসিনা। শেষমেশ জন রোষানলে পড়ে দেশ ত্যাগে বাধ্য হলেন তিনি।
বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ক্ষমতার চেয়ারে রাজত্ব করেছেন শেখ হাসিনা। চলতি বছরের জানুয়ারিতে চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় বসেন তিনি। যদিও সেই নির্বাচনে অংশ নেয়নি প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। পরে নিজেদের দলের প্রার্থীদেরই ডামি প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য করে দেশ গড়ার শপথ নেন শেখ হাসিনা। যদিও এ দফায় মাত্র ৭ মাসেই পদত্যাগ করে দেশ ছাড়তে হয়েছে তাকে।
কেননা, সাম্প্রতিক বছরগুলিতে স্বৈরাচারী মনোভাব হয়ে উঠেছিল তার। নিজের শাসনের বিরোধিতাকে দমন করেছেন কঠোর হাতে। রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত গ্রেফতার, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং অন্যান্য অপব্যবহার সবই তার শাসনে বেড়ে গিয়েছিল। কোট সংস্কারের দাবিতে নামা সাধারণ শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক ট্যাগ দেওয়া ও তাদের স্বাধীনতার অপশক্তি ‘রাজাকার’ হিসেবে সম্বোধন করে ব্যাপক ক্ষোভের মুখে পড়েন তিনি।
এর বাইরে সবশেষ তিনটি নির্বাচনে বিরোধী দলকে দমন করা ও এককভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চেয়েছিলেন তিনি। যেই লক্ষ্যে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিজের স্বপক্ষে কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন শেখ হাসিনা। তবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছিলেন না বাজার পরিস্থিতি। জনগণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যেতে শুরু করেছিল নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস।
অন্যদিকে শেখ হাসিনা সরকারের মন্ত্রী এমপিরা ব্যাপক দুর্নীতিতে জড়িত পড়েছিলেন। অনেকেই দেশের টাকা মেরে বিদেশে বাড়ি গাড়ি করেছেন। দেশের টাকা লুট করে ব্যাংকগুলোকে খালি করে দিয়েছেন অনেকেই। আর এই সব কিছুর ক্ষোভ শেষ পর্যন্ত দাবানলে রূপ নেয় জুলাই মাসের শেষ দিকে। এসময় ছাত্রদের দমনে আওয়ামী লীগ ও নিজের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেন তিনি। যাতে সংঘাতে জড়িয়ে নিহত হয় চারশোর বেশি মানুষ। এরপরও পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলেও গণ আন্দোলনের মুখে সোমবার বাধ্য হয়ে ক্ষমতা ছাড়তে হয় স্বৈরাচার শেখ হাসিনাকে।
অথচ, এক সময় শেখ হাসিনা পরিচিত ছিলেন গণতন্ত্রের আইকন হিসেবে। ১৯৭৫ সালে নিজের পরিবারের সদস্যদের হারানোর পর ১৯৮১ সালে দেশে ফেরেন শেখ হাসিনা। তৎকালীন জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সামরিক শাসনের সময় গণতন্ত্রপন্থি রাস্তায় বিক্ষোভ করার জন্য তিনি অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সাথে হাত মিলিয়েছিলেন। জনগণের অভ্যুত্থানের দ্বারা চালিত হাসিনা তখন জাতীয় আইকনে পরিণত হন।
এরপর ১৯৯৬ সালে প্রথম ক্ষমতায় আসেন তিনি। ভারতের সাথে পানি-বণ্টন চুক্তি এবং উপজাতীয় বিদ্রোহীদের সাথে একটি পার্বত্য শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করার জন্য কৃতিত্ব অর্জন করেন। কিন্তু একই সময়ে, সরকারের বহু দুর্নীতিমূলক কর্মকাণ্ড ও ভারতের খুব অধীন হওয়ার জন্য সমালোচিত হন। যার প্রভাব পড়ে ২০০১ নির্বাচনে। ক্ষমতায় আসে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। খালেদা জিয়ার শাসন আমলের শেষ দিকে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরে আওয়ামী লীগের তীব্র আন্দোলনে ক্ষমতা ছাড়েন বেগম জিয়া। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ২০০৯ সালে ফের ক্ষমতার চেয়ারে বসেন শেখ হাসিনা।
২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশের কাতার থেকে ক্রমান্বয়ে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয় দেশ। তার নেতৃত্বে অবিশ্বাস্য অর্থনৈতিক সাফল্য পায় বাংলাদেশ। দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ হিসেবে বিশাল জনগোষ্ঠীর ভারতকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশ। গত দশকে মাথাপিছু আয় বেড়েছিল তিনগুণ। এর বাইরে নানা উন্নয়নমূলক কাজ যেমন, পদ্মা সেতু, মেট্রো রেলসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক অবকাঠামো স্থাপন করেন শেখ হাসিনা।
তবে সম্প্রতি বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন তিনি। বিতর্কিত তিনটি নির্বাচনের পর বেসামরিক চাকরিতে কোটা বাতিলের দাবি নিয়ে অস্থিরতা শুরু হয়েছিল শেষ কিছুদিন ধরে। পরে যা সরকারবিরোধী আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল। কেননা, কোটা সংস্কার আন্দোলন কারীদের দমনে তিনি পুলিশকে ব্যবহার করেন। এছাড়াও করোনা মহামারীর পর থেকেই বাংলাদেশ জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয়ের সাথে লড়াই করতে হচ্ছিল সবাইকে।
বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীও দীর্ঘদিন ধরে গুরুতর অপব্যবহার ও নির্যাতনের অভিযোগে অভিযুক্ত ছিল। যার কারণে ২০২১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নকে নিষেধাজ্ঞা দেয়। এর বাইরে শেখ হাসিনার দলীয় নেতাকর্মীরা বিভিন্ন অঞ্চলে দমন পীড়ন করছিল। যা সব মিলিয়ে জনগণের মধ্যে ব্যাপক আক্রোশ জমা হচ্ছিল। সেই আক্রোশের কারণেই তীব্র আন্দোলন শুরু হয়। যা তাকে শেষ পর্যন্ত পদত্যাগ করে দেশ ছাড়তে বাধ্য করেছে। একসময়ের গণতন্ত্রের আইকন শেষ বেলায় স্বৈরাচার হিসেবে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন।