বাংলার ভোর প্রতিবেদক
দেশের প্রথম আইটি পার্ক যশোরের শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কটি গতিশীলতা আনতে ৮দফা দাবি জানিয়েছে পার্কটির বর্তমান ইনভেস্টরস অ্যাসোসিয়েশন।
শনিবার দুপুরে পার্কটির খোলা চত্বরে পার্ক ইনভেস্টরস অ্যাসোসিয়েশন’ (এসএইচএসটিপিআইএ) আয়োজিত জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে এই দাবি জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে পার্কের নাম পরিবর্তন করে ‘যশোর সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক’ এবং এর প্রধান ভবনটি (এমটিবি) সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থানে শহীদ ফ্রিল্যান্সার মীর মুগ্ধর নামে নামকরণের দাবি তোলেন নেতৃবৃন্দ।
একই সাথে পার্কটির দায়িত্বে থাকা কোম্পানি টেকসিটির সঙ্গে সম্পাদিত জনস্বার্থবিরোধী চুক্তি বাতিল করে আগামী তিন কর্মদিবসের মধ্যে যশোরের শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কের নিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষকে গ্রহণ করতে আল্টিমেটাম দিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন ইনভেস্টরস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার মো. শাহজালাল। সাংবাদিকদের নানা প্রশ্নের জবাব দেন সংগঠনের উপদেষ্টা ও প্রেসক্লাব যশোরের সভাপতি জাহিদ হাসান টুকুন এবং সংগঠনের সভাপতি আহসান কবীর।
যশোরে ২০১৭ সালের ১০ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে দেশের প্রথম আইটি পার্ক শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক। শহরের নাজির শঙ্করপুর এলাকায় ১২ একরের জমিতে স্থাপিত প্রতিষ্ঠানটির লক্ষ্য ছিল দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের উন্নয়ন, জ্ঞানভিত্তিক শিল্প স্থাপন, উদ্যোক্তাদের ব্যবসা পরিচালনার জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি।
উদ্বোধনের পরে হাজারো মানুষের কর্মসংস্থানের সঙ্গে হাতছানি দিয়েছিলো দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের উন্নয়ন ও উদ্যোক্তা সৃষ্টির। এখন সেই আইটি পার্ক বিনিয়োগকারীদের কাছে ক্ষোভ আর হতাশার নাম। পার্কে আইকনিক ভবন স্বর্বস্ব ছাড়া কিছুই নাই। বর্তমানে নানা সংকট সমস্যার মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত করছেন পার্কটির বিনিয়োগকারীরা।
একটিমাত্র বিদেশি কোম্পানি এই পার্কে জায়গা বরাদ্দ নিলেও তিন বছর আগে সেটিও পার্ক ছেড়ে চলে গেছে। এমনকি বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে প্রথমদিকে চুক্তিবদ্ধ ৩৩টির মধ্যে ২৬টি কোম্পানি পার্ক ছেড়ে চলে গেছে। অবশিষ্ট যে সাতটি কোম্পানি রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে অধিকাংশই রুগ্ন।
পার্কটিতে অপারেশনে থাকা হাতেগোপনা চার থেকে পাঁচটি কোম্পানি সফটওয়্যার তৈরি বা বিপণন নিয়ে কাজ করে। অবশিষ্ট কোম্পানিগুলো ই–কমার্স, কল সেন্টার, ইন্টারনেট সেবাদানকারী, ডিজিটাল মার্কেটিংসহ বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ৩০৫ কোটি টাকার সরকারি প্রকল্পটি কোনো বিনিয়োগ ছাড়াই পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয় টেকসিটি নামে একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে। আশ্চর্য্যজনক হলেও সত্য, শেখ হাসিনা পার্ক থেকে অর্জিত রাজস্বের ৮২ শতাংশের ভাগিদার টেকসিটি; যাদের কার্যত কোনো বিনিয়োগই নেই। সরকারের প্রাপ্য ১৮ শতাংশের বড় অংশ আবার লুটেরা কোম্পানি টেকসিটি নানা কারসাজির মাধ্যমে আত্মসাৎ করে।
সংবাদ সম্মেলনে আরও বেশকিছু দাবিদাওয়া তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে রয়েছে, পার্কের স্পেস ভাড়া যশোরের বাস্তবতার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ করতে সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনা, ভৌতিক বিদ্যুৎ বিলসমূহ প্রত্যাহার করে ব্যবহার অনুযায়ী বিল ইস্যু করা, স্থানীয় ও ক্ষুদ্র-মাঝারি বিনিয়োগকারীদের ব্যবসার ধরন অনুয়ায়ী সরকারি কাজে অংশগ্রহণের সুযোগদান, ব্যবসা প্রসার ও কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে এই পার্কের জন্য বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ, হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের নির্বাহী কমিটি থেকে ওয়াহিদ শরীফকে অপসারণ করে তদস্থলে এসএইচএসটিপি’র প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত করা প্রভৃতি।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জানানো হয়, বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা বিনিয়োগকারীদের দাবি যে যৌক্তিক, তা অনুধাবন করেন। বিনিয়োগকারীদের দাবি মেনে নিতে তারা আন্তরিকও বটে। কিন্তু পতিত সরকারের অলিগার্ক ওয়াহেদ শরীফদের দৌরাত্ম্যে সরকারি কর্মকর্তারা অসহায় হয়ে ছিলেন। শেখ হাসিনা পার্কে স্বার্থ থাকলেও সম্পূর্ণ অনিয়মতান্ত্রিকভাবে হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের নীতিনির্ধারণী ফোরাম ‘নির্বাহী কমিটিতে’ ওয়াহেদ শরীফ জায়গা করে নেন। সেখানে বসে তিনি বিনিয়োগকারীদের সব ন্যায্য দাবিদাওয়া নাকচ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। সংবাদ সম্মেলনে পার্কে জেঁকে বসা টেকসিটির আরও নানা অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয় তুলে ধরা হয়। নানা সময়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত ডকুমেন্টও সংবাদকর্মীদের সরবরাহ করা হয়।
গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার নামে পার্কটি হওয়ায় এবং এটির পরিচালনায় সাবেক সরকারের সুবিধাভোগীরা থাকায় স্থাপনাটি গণআক্রোশের শিকার হচ্ছে। গত কয়েকদিনে অন্তত তিন দফা এখানে আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। পার্কটির প্রধান ফটকে শেখ হাসিনার নাম, ভিতরে উদ্বোধনের ফলক ভাংচুর করা হয়েছে। যার একটিও মোকাবেলা করতে পারেনি টেকসিটি। পার্কসহ প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হয়েছে বিনিয়োগকারীদের।
ফলে এই ব্যর্থ প্রতিষ্ঠানের এখানে দায়িত্ব পালনের আর কোনো সুযোগ নেই। তারা দায়িত্বে থাকলে আরও অঘটন ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করেন বিনিয়োগকারীরা। ফলে তিন কর্মদিবসের মধ্যে টেকসিটিকে অব্যাহতি দিয়ে সরকারি কর্তৃপক্ষ পার্কটির দায়িত্ব না নিলে সংবাদকর্মী ও যশোরবাসীকে সঙ্গে নিয়ে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে মামলা করা হবে কি না-এমন প্রশ্নের সরাসরি জবাব দেননি অ্যাসোসিয়েশন নেতারা। তারা জানান, এটি তাদের কার্যনির্বাহী কমিটির পরবর্তী সভায় বিবেচনা করা হবে।
সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের সহসভাপতি ইমানুর রহমান ইমন, যুগ্মসম্পাদক এএইচএম আরিফুল হাসনাত, কোষাধ্যক্ষ নাহিদুল ইসলাম, কার্যনির্বাহী সদস্য আনিকা হাসান, সাবেক সহসভাপতি মনসুর আলী, সাধারণ সম্পাদক মহিদুল ইসলামসহ বিপুল সংখ্যক বিনিয়োগকারী ও অফিসপ্রধান উপস্থিত ছিলেন।