বাংলার ভোর ডেস্ক
‘পাহাড়ি ও বাঙালিদের’ মধ্যে সংঘর্ষে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে পার্বত্য তিন জেলা। সহিংসতায় খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে অন্তত ৪ জন নিহতের খবর পাওয়া গেছে। এরমধ্যে খাগড়াছড়িতে তিনজন ও রাঙামাটিতে একজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও অনেকেই। বৃহস্পতিবার রাতে খাগড়াছড়ি আধুনিক সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। নিহতরা হলেন, ধনঞ্জয় চাকমা (৫০), রুবেল ত্রিপুরা (২৫) ও জুনান চাকমা (২০)। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ১৪৪ ধারা জারি করেছে জেলা প্রশাসন। পার্বত্য শহর রাঙামাটিতে একজন নিহত হয়েছে। তবে তার পরিচয় শনাক্ত হয়নি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে শহরে ১৪৪ ধারা জারি করেছে জেলা প্রশাসন।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম রেঞ্জ পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) আহসান হাবিব পলাশ বলেন, বৃহস্পতিবার ‘পাহাড়ি ও বাঙালিদের’ মধ্যে সংঘর্ষে দীঘিনালায় ধনঞ্জয় এবং সদরে রুবেল ও জুনান আহত হয়েছিলেন। পরে তাদের খাগড়াছড়ি আধুনিক সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে ধনঞ্জয় এবং রাত দেড়টায় রুবেল ও জুনান মারা গেছেন। এদিকে নাশকতা রোধে খাগড়াছড়ি পৌর শহর ও জেলা সদরে শুক্রবার বেলা ২টা থেকে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক মো. সহিদুজ্জামান। তিনি বলেন, যে কোনো ধরনের সহিংসতা রোধে জেলা প্রশাসন এ ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে। এর আগে বৃহস্পতিবার বিকালে খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় ‘পাহাড়ি ও বাঙালিদের’ মধ্যে সংঘর্ষ থেকে স্থানীয় বাজারে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছিল।
জেলা পুলিশ সুপার আরিফিন জুয়েল বলেন, রসখানে পাহাড়ি-বাঙালি উত্তেজনা চলছিল। সেখান থেকেই বৃহস্পতিবার সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। এ সময় দুপক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে এবং দোকানপাটে অগ্নিসংযোগ করা হয়। স্থানীয়রা জানান, বৃহস্পতিবার রাতে (আনুমানিক রাত সাড়ে ১০টা) জেলা শহরের নারানখখাইয়া, স্বনির্ভর এলাকায় ব্যাপক গুলির শব্দ শোনা যায়। থেমে থেমে গভীর রাত পর্যন্ত গুলির শব্দ পাওয়া যায়।
খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) রিপল বাপ্পি চাকমা বলেন, হাসপাতালে আহত অবস্থায় আনা হয়েছে ৯ জনকে। তারা বেশির ভাগই সদর উপজেলা থেকে রাতে এসেছেন। এর মধ্যে তিনজন মারা যান। তিনি আরও বলেন, গুরুতর আহত চারজনকে রাতেই উন্নত চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে একজন বাঙালি রয়েছেন। নিহত তিনজনের মরদেহ সদর হাসপাতালের মর্গে রয়েছে। তাদের মৃত্যুর কারণ ময়নাতদন্ত শেষে বলা যাবে, জানান রিপল বাপ্পি চাকমা।
রাঙামাটিতে সহিংসতায় নিহত ১:
খাগড়াছড়ির সহিংসতা ও মৃত্যুর ঘটনার পর সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে আরেক পার্বত্য শহর রাঙামাটিতেও। এতে একজনের মৃত্যু হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ১৪৪ ধারা জারি করেছে জেলা প্রশাসন। শুক্রবার (২০ সেপ্টেম্বর) সকালে শহরের জিমনেসিয়াম চত্বর থেকে কয়েক হাজার পাহাড়ী একটি মিছিল নিয়ে বনরূপায় গেলে সেখানে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করা হয়েছে বলে অভিযোগ করে বাঙালিদের বেশ কিছু দোকানপাট ও বনরূপায় কয়েকটি ধর্মীয় স্থাপনায় ভাংচুর করা হয়। এসময় রাস্তায় চলাচলকারী প্রচুর যানবাহন ভাংচুর করা হয়। এ ঘটনার পর লাঠিসোঠা নিয়ে মাঠে নামে বাঙালিরাও। তাদের পাল্টা হামলায় ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় কাঠালতলীতে অবস্থিত মৈত্রী বিহার। আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয় বনরূপায় পাহাড়িদের মালিকানাধিন দুটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।
রাঙামাটি পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. জামালউদ্দিন জানান, সকালে পাহাড়ীদের একটি মিছিল বনরূপায় এসে ফিরে যাওয়ার সময় বিনা উস্কানিতেই বনরূপায় দেদারসে বাঙালিদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বনরূপা মসজিদে হামলা ও ভাংচুর করে, বেশ কয়েকটি গাড়ি ভাংচুর করে। এরপরই বাঙালি ব্যবসায়িরা সংঘবদ্ধ হয়ে তাদের পাল্টা ধাওয়া দেয়। এসময় ধাওয়া সংঘর্ষ হয়।’
রাঙ্গামাটি সদর জেনারেল হাসপাতালে দায়িত্বরত চিকিৎসক ডা. সাদিয়া আক্তার বলেন, এখন পর্যন্ত অন্তত ৫০ জন আহত হয়েছে। এছাড়া একজন মারা গেছেন। তবে তার পরিচয় এখনো জানা যাযনি। এদিকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে শহরের ১৪৪ ধারা জারি করেছে জেলা প্রশাসক মো. মোশারফ হোসেন খান।
তিনি জানান, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পৌর এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে।
এর আগে বুধবার খাগড়াছড়ির নিউজিল্যান্ড এলাকায় গণপিটুনিতে মামুন নামে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল বের করে দীঘিনালা ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থীরা। বিক্ষোভ মিছিলটি লারমা স্কয়ারের দিকে যাওয়ার সময় পাহাড়ীরা বাধা দিলে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। পরে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে লারমা স্কয়ারে দোকানপাট ও বসত বাড়িতে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এতে পুড়ে যায় অন্তত ৫০/৬০টি দোকান। নিহত হয় তিনজন।
বান্দরবনে দুর্গম পাহাড়ে বিজিবির অভিযান:
বান্দরবানের দুর্গম সীমান্তবর্তী দোপানিছড়ায় সন্ত্রাসী আস্তানার সন্ধান পেয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। সেই আস্তানা থেকে অস্ত্র-গোলাবারুদ, ড্রোন ও সিগন্যাল জ্যামারসহ অত্যাধুনিক প্রযুক্তির বিভিন্ন সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়েছে। শুক্রবার (২০ সেপ্টেম্বর) বিজিবি সদরদপ্তরের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরীফুল ইসলাম এ তথ্য জানান।
তিনি জানান, বিশেষ গোয়েন্দা সূত্রের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, বান্দরবানের রুমার দুর্গম সীমান্তবর্তী দোপানিছড়া এলাকা সংলগ্ন গহীন জঙ্গলে একটি আস্তানা স্থাপন করে একদল পাহাড়ি সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাচ্ছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বিজিবির রুমা ব্যাটালিয়নের (৯ বিজিবি) অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল হাসিবুল হকের নেতৃত্বে রুমার দুর্গম সীমান্তবর্তী দোপানিছড়া এলাকার আনুমানিক সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে সীমান্ত সংলগ্ন পাহাড়ি গহীন জঙ্গলে একটি সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা হয়।
অভিযানে সন্ত্রাসীদের আস্তানা থেকে দুটি অটোমেটিক কারবাইন অ্যাসল্ট রাইফেল, একটি সেমি অটোমেটিক অ্যাসল্ট রাইফেল, তিনটি এসবিবিএল, ২১ রাউন্ড তাজা গুলি, একটি অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ড্রোন, একটি অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সিগন্যাল জ্যামার, একটি অডিও/ভিডিও রেকর্ডার, একটি ভিডিও ক্যামেরা, একটি অত্যাধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর গোয়েন্দা বোতাম ক্যামেরা, একটি কি-ডিভাইস হিডেন ভিডিও রেকর্ডার, একটি দূরবীণ, দুটি ওয়াকিটকি, একটি ল্যাপটপ, দুটি পাওয়ারফুল লাইট, একটি সোলার সিস্টেম, একটি আকাশ টিভি রিসিভার ও একটি আমব্রেলা, দুটি অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোন, দুটি বাটন মোবাইল ফোন, দেশীয় বিভিন্ন ধারালো অস্ত্র, বাংলা মদ, একটি হেলমেট, রান্নার প্রয়োজনীয় উপকরণ এবং রসদসামগ্রী উদ্ধার করা হয়। এছাড়াও ওই স্থানে অবজারভেশন পোস্ট, পরিখা, অস্থায়ী অস্ত্রাগার, বিশ্রামাগার, কুক হাউজ ইত্যাদির সন্ধান পাওয়া যায়। যার সবকিছু সমূলে ধ্বংস করা হয়েছে বলেও জানান বিজিবির এ কর্মকর্তা।