হাসান আদিত্য
চারিদিকে শুধুই জল। জেগে আছে রাস্তা। বাড়ির বারান্দা থেকে রাস্তার সঙ্গে সংযোগে ভরসা বাঁশের সাঁকো। উঠানে শ্যাওলা ভাসা কোমরসমান জল। রান্নাঘর, শোবারঘর, গোয়ালঘর তলিয়ে গেছে। সাপ-পোকা মাড়কের সঙ্গে দোচালা পাঁকা টিনের এই বাড়িতেই ১০ সদস্য পরিবারের দুর্বিষহ জীবন। বলছিলাম যশোরের অভয়নগরের রাজাপুরের সুবাস চন্দ্র মল্লিকের পরিবারের কথা।
আসন্ন শারদীয় দুর্গোৎসব ঘিরে পরিবারটিতে নেই আনন্দ আয়োজন। তাদের কাছে এই মূর্হতে বেঁচে থাকাই যেন পরম আনন্দের। সুবাস চন্দ্র মল্লিক বলেন, ‘ভবদহ এলাকায় এমন কোন বাড়ি নাই যে, উঠান বাড়িতে হাটু সমান পাানি। খাওয়া দাওয়া ঠিক মতো হচ্ছে না। সুবাশের পঞ্চাশর্ধো স্ত্রী সূর্যবালা মল্লিক মনমরা হয়ে সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। বাড়িতে পূজার আয়োজন নিয়ে জানতে চাইতেই তিনি বলেন, ‘বাড়ি থাকতে পারছি নে। তার পূজার আয়োজন। বাড়ির যা অবস্থা পূজার কেনাকাটা উৎসব নেই মনে। এখন কি করে বাঁচবো; কি করে দুটো রান্না করে খাবো সেটাই চিন্তা করছি।’
শুধু এই পরিবার নয়; হিন্দু অধ্যুষিত ভবদহ এলাকায় শারদীয় দুর্গোৎসবের আনন্দ নেই। টানা দুই মাসেরও বেশি সময় জলাবদ্ধতায় চরম সংকটে আছেন এখানকার মানুষ। বাড়ি, ধর্মীয় স্থানে জলমগ্ন থাকায় বেশির ভাগ স্থানেই হচ্ছে না পূজার আয়োজন। ফলে এ অঞ্চলের ঘরে ঘরে নেই পূজার উৎসব। যেখানে হচ্ছে, সেটিও সীমিত পরিসরে। এ পরিস্থিতিতে তাদের জলবদ্ধতার সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকায় বড় চ্যালেঞ্জ।
সরেজমিনে ঘুরে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যশোরের অভয়নগর, মনিরামপুর ও কেশবপুর এবং খুলনার ডুমুরিয়া ও ফুলতলা উপজেলার অংশবিশেষ নিয়ে ভবদহ অঞ্চল। পলি পড়ে এই অঞ্চলের পানিনিষ্কাশনের মাধ্যম মুক্তেশ্বরী, টেকা, শ্রী ও হরি নদী নাব্যতা হারিয়েছে। ফলে নদী দিয়ে পানি নামছে না। এ অঞ্চলে যত দূর চোখ যায় শুধু পানি আর পানি।
খেতের ফসল, ঘেরের মাছ সবই কেড়ে নিয়েছে এই পানি। কেড়ে নিয়েছে মানুষের থাকার জায়গাটুকুও। ৪০০টি গ্রামের বেশির ভাগ ঘরবাড়ি, ধর্মীয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাট, কৃষিজমি এবং মাছের ঘের প্লাবিত হয়েছে। পানির কাছে হেরে যাচ্ছে ভবদহ অঞ্চলের চার লাখ মানুষ।
স্থানীয়রা জানান, হিন্দু অধ্যুষিত ভবদহ এলাকায় আবহামানকাল থেকে প্রতিটি পাড়াতে জমকালো আয়োজনের উদযাপন হয় সনাতন ধর্মালম্বীদের বড় উৎসব দুর্গাপূজা। কিন্তু পাড়া মহল্লা মন্দির মন্ডপে জলাবদ্ধতার কারণে ৩১টি স্থানে হচ্ছে না পূজা। একই সাথে ফসল ও মাছের ঘের তলিয়ে যাওয়ায় অর্থ সংকটে থাকার কারণে ইচ্ছা থাকলেও অনেকেই আয়োজন করেনি পূজা। এদিকে বাড়ির পাশে পূজা না হওয়ায় উৎসবের আয়োজন নেই ঘরে ঘরে। তাই নতুন পোশাক কেনাকাটাও করেননি তারা।
অভয়নগর উপজেলাতে জমকালো আয়োজনের মধ্যে দিয়ে অন্যতম দুর্গোৎসব হয় রাজাপুর সার্বজনীন মন্ডপে। এবার মন্ডপে জলমগ্ন থাকাতে হচ্ছে না পূজা। মন্ডপের ভিতরে হাটু সমান পানি। পড়ে রয়েছে এ বছরের প্রতিমা তৈরি করার অসম্পূর্ণ কাঠামো। গত সোমবার গিয়ে দেখা যায়, মন্ডপের চারিপাশে কোমর সমান পানি। এমনকি মন্ডপের ভিততেরও হাটু সমান পানি। এই মন্ডপের অন্যতম নেতা সুশান্ত বর্মন বলেন, ‘এ বছর জলের কারণে পূজা হচ্ছে না। গত বছরে মন্ডপের সামনের মাঠে বিশাল সামিয়ানা করে ভক্ত দর্শনার্থীদের জন্য প্রসাদ দেওয়া হয়েছিলো ।
এবছর মন্ডপ মাঠে পানি থৈ থৈ করছে। ইচ্ছা থাকলেও এবার আয়োজন নেই কোন। বছরের অন্য সময়ে যে সড়কে হেঁটে দিপালি রায় বাড়ি থেকে অন্যত্র গেছেন; সেই সড়কে এখন কোমর পানি। সেই সড়কের উপর দাঁড়িয়ে গৃহস্থালি জামা কাপড় ধুচ্ছেন।
এসময় তিনি বলেন, ‘বাবা আমাদের দুঃখ, কেউ দেখলো না। সরকারের পর সরকার গেল আমাদের সমস্যা ঠিক হলো না। তিনি বলেন, ‘মায়ের পূজা তো বছরে একবারই করি, কিন্তু না করতে পারলে কি করবো! অনেক কষ্ট হচ্ছে এবার পূজা করতে না পারাতে।’
ফুলেরগাতি এলাকার পরিতোষ মল্লিক বলেন, ব্যাপক উৎসব করে এলাকায় পূজা হয়। আত্মীয় স্বজন আসে। এবার তো নিজেরাই থাকতে পারছি না।
তিনি বলেন, পূজা করতে দেড় দুই লাখ টাকা খরচ হয়। কিন্তু এবার এই অঞ্চলের কৃষি জমি, মাছের ঘর ভেসে শত শত চাষী ক্ষতিগ্রস্ত। আবার বাড়ি ঘরে পানি। সবমিলিয়ে বেঁচে থাকায় দায়। এই মূর্হতে কোন আনন্দ নেই। উৎসবও নেই। ভিন্ন চিত্র রয়েছে আবার কয়েক জায়গাও। কয়েক জায়গায় বালি দিয়ে উচু করে অস্থায়ী মন্ডপও করতে দেখা গেছে। সেখানে সীমিত পরিসরে চলছে পূজার আয়োজন। সুজলী বাজার এলাকায় এমন একটি মন্ডপে দেখা গেছে মন্ডপের চারিপাশে জলাবদ্ধতা।
তবে বালি দিয়ে উচু করা হয়েছে প্রতিমা রাখার জন্য। ইতিকা মল্লিক নামে এক গৃহ বধূ জানান, ‘জলের কারণে মনে অশান্তি। এর মধ্যে মা আসছে। মায়ের পূজাটা কোন রকমে এ বছরে সেরে দিবো। এমন পরিস্থিতিতে দ্রুত পানি নিস্কাশনের সঙ্গে টিআরএম চালু ও আমডাঙ্গা খাল সংস্কারের দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী পলাশ কুমার ব্যানাজি বলেন, এবার অতিবৃষ্টির কারছে ভবদহ সমস্যা স্থায়ী সমস্যায় রুপ নিয়েছে। বৈদ্যুতিক সেচযন্ত্র দিয়ে পানি সরানোর কাজ চলছে। গত দুই দিনে তেমন বৃষ্টি হয়নি। এমন আবহাওয়া থাকলে দ্রুত এই জলাবদ্ধতা কমে যাবে।
এদিকে জেলা পূজা পরিষদ জানিয়েছে, এবছর জেলায় ৬৫২টি মন্দির ও মন্ডপে পূজার আয়োজন চলছে। তবে গত বছরের তুলনায় এবার ৮০টি স্থানে পূজা হচ্ছে না। এর মধ্যে ভবদহ অঞ্চলে কমেছে ৩১টি। জেলা কমিটির দীপঙ্কর দাস রতন বলেন, ‘ভবদহ সমস্যা ও রাজনীতিক পটপরিবর্তনে অস্থিতিশীল পরিবেশে কমেছে পূজার আয়োজন। ঘরে ঘরে নেই আগের মতো উৎসব আনন্দ। তবে জেলা প্রশাসন, রাজনীতিক দলগুলো পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
জেলা বিএনপির সদস্য সচিব সৈয়দ সাবেরুল হক সাবু বলেন, প্রতিটি মন্দির মন্ডপে কমিটি করা হয়েছে। পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবী হিসাবে কাজ করছে। জেলার প্রতিটি পূজামণ্ডপে কমিটি করেছে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনীতিক দল।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নূর-ই-আলম সিদ্দিকী জানান, যশোরে পূজামণ্ডপে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। কোথাও অপ্রতিকর ঘটনা যাতে না ঘটে, পোশাকে ও সাদা পোশাকে মাঠে থাকবে পুলিশ। এবারের দুর্গাপূজা ঘিরে ব্যাপক তৎপর রয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।